সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে কর অব্যাহতি দেওয়ার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। অনেকেই এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন, আবার কেউ কেউ এর সমালোচনা করছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এই কর অব্যাহতির পেছনে থাকা কারণগুলো এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ক্ষুদ্রঋণ খাতের ভূমিকা, এবং নীতিগত বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে।
### ১. **গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য**
১৯৭৬ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, মূলত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যাংকটির লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ জনগণের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে অনেক নারী এবং দরিদ্র মানুষ নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলেছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
### ২. **ক্ষুদ্রঋণ খাতের ভূমিকা**
ক্ষুদ্রঋণ খাতটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই খাতের লক্ষ্য মূলত তাদের জন্য ঋণ প্রদান করা, যারা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুবিধা পায় না। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক এই খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে তুলেছে, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো কর অব্যাহতি পেলে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা বজায় থাকে এবং তারা আরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সহায়তা করতে পারে। এ কারণেই সরকার বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে।
### ৩. **কর অব্যাহতির কারণ**
এনবিআর-এর সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে গ্রামীণ ব্যাংককে ২০২৯ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছে, তা বিবেচনায় এনেই এই কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর-এর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, “ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও একই ধরনের কর সুবিধা পায়। গ্রামীণ ব্যাংক যেহেতু এ সুবিধা থেকে বাদ পড়েছিল, তাই এটি পুনরায় প্রদান করা হয়েছে। এটা ন্যায্যতা ও সমতার প্রশ্ন।”
গ্রামীণ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই নিঃশর্ত কর মওকুফের সুবিধা পেয়ে আসছিল। তবে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগ সরকার এ সুবিধা বন্ধ করে দেয়। এবার সেই সুবিধা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এনবিআর-এর বক্তব্য অনুযায়ী, ক্ষুদ্রঋণ খাতের ন্যায্য প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
### ৪. **সমালোচনা ও বিতর্ক**
এনবিআরের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। বিশেষত, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক এবং তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর প্রেক্ষিতে এই কর অব্যাহতির সিদ্ধান্তকে অনেকেই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, কেন অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এই ধরনের সুবিধা পাচ্ছে না, বা কেন গ্রামীণ ব্যাংকই বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। অনেকে আবার বলছেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা টানাপোড়েনের কারণে পূর্ববর্তী সরকারের নীতিগত পরিবর্তনই এই কর অব্যাহতির পিছনে কাজ করেছে।
### ৫. **অর্থনৈতিক প্রভাব ও বিশ্লেষণ**
বিশেষজ্ঞদের মতে, কর অব্যাহতির ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমে যাবে, যা তাদের আরও বেশি মানুষকে ঋণ দেওয়ার সুযোগ করে দেবে। এটি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর অব্যাহতি দেওয়া হলে তারা নিজেদের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে পারে এবং দরিদ্র মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "আইনের আওতায় না থাকলে, গ্রামীণ ব্যাংককে ২০২০ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া সম্ভব হতো না।" তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, পূর্ববর্তী সরকারের নীতিগত অবস্থান এবং আইনের ব্যাখ্যায় কিছু অস্পষ্টতা থাকায় গ্রামীণ ব্যাংকের কর সুবিধা নবায়ন করা হয়নি।
### ৬. **অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং সমতা**
এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে শুধু গ্রামীণ ব্যাংক নয়, অলাভজনক দাতব্য সংস্থা আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনকেও ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এটি সরকারের দাতব্য ও সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন করার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানও একই ধরনের কর সুবিধা পেয়ে থাকে, যা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তাদের টিকে থাকতে সহায়তা করে।
### ৭. **উপসংহার**
গ্রামীণ ব্যাংককে ২০২৯ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হল ক্ষুদ্রঋণ খাতের সামাজিক উন্নয়নে অবদান এবং দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর ইতিবাচক প্রভাব। যদিও এ সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে, অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকদের মতে, এটি ক্ষুদ্রঋণ খাতকে সমর্থন করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে।