#বেলা_শেষে। [০১]
বন্ধুমহলে নিজের স্ত্রীকে কাজের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দিলো দিগন্ত। দিগন্তের কথায় একটুও অবাক হয়নি ভূমিকা। দিগন্ত ভূমিকাকে কখনও স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না এটা খুব ভালো করেই জানে। বিয়ের পাঁচ মাসে এইটুকু বুঝে গেছে ভুমিকা। দিগন্তের সব বন্ধুরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ভুমিকার দিকে। ভূমিকা করুন চোখে দিগন্তের দিকে তাকালো। তখন দিগন্তের মুখ ছিলো হাস্যউজ্জল। হেসে হেসে বন্ধুদের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত সে। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে চলে আসলো ভূমিকা। রান্নাঘরে এসে অঝর ধারায় কান্না শুরু করে ভূমিকা।
হাতের উল্টাপিঠে দু চোখের পানি মুছে নেয় ভূমিকা। এখন তার কাঁদলে চলবে না। সে তো কাজের মেয়েই। দিগন্ত তো কোন ভুল বলে নি। উহঃ এখনও কত কাজ করার বাকি দিগন্তের বন্ধুদের জন্যে চা বসাতে হবে। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে চা বানাতে শুরু করে ভুমিকা।
এদিকে দিগন্ত ওর বন্ধুদের সাথে গল্পে মশগুল। হেসে হেসে সবার সাথে গল্প করছে সে। মাহিন, মানে দিগন্তের এক বন্ধু তাকিয়ে আছে রান্নাঘরে থাকা সেই রমনীর দিকে।ঘর্মাক্ত শরীর, মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠে লেপ্টে আছে। লালসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই রমনীর দিকে। দিগন্ত বিষয়টা খেয়াল করলেও তেমন পাত্তা দেয়না। দীর্ঘ দুই মাস পর বন্ধুদের সাথে দেখা। এখন তাদের সাথে বসে গল্প করাই দিগন্তের একমাত্র লক্ষ। সবাই যখন কথা বলায় ব্যাস্ত মাহিন নিঃশব্দে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
মাহিন রান্নাঘরে আসতেই তার চোখ পড়ে ভূমিকা শাড়ির আঁচল গুজে থাকা সেই অবাধ্য স্থানে। লালসার দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ভূমিকা চা বানানো শেষ প্রতিটা কাপে চা ঢেলে নেয়। এরপর একটা ট্রেতে করে চায়ের কাপ নিয়ে পিছনদিকে ঘুরতেই তার সামনে পরে মাহিনের লালসাদৃষ্টি। ওষ্ঠের উপর হাত বুলিয়ে মিটমিট করে হাসছে মাহিন। মাহিনের চাহনি দেখে ভুমিকা ভয়ে কুকড়িয়ে উঠে। শুকনো ডুগ গিলে কাপাকাপা গলায় বলে,
-আ- আপনি এখানে? কিছু লাগবো?? মাহিন হাত দিয়ে তার গলে স্লাইড করে দুপা এগিয়ে ভুমিকার সামনে দাঁড়ায়।ঠোটের কোনে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বলে,
-তোমাকে লাগবে ডার্লিং।
-মা- মানে??
-কামওন ডার্লিং এত ভয় কেন পাচ্ছো। শুনো আমি জানি তুৃমি কাজের মেয়ে নও। কাজের মেয়ে কখনও এত দামি শাড়ি পরে না। তোমাকে একটা অফার দিচ্ছি, আমাকে বিয়ে করবে। মাহিন তোমাকে কাজের মেয়ে করে রেখেছে আমি তোমাকে রাজরানি করে রাখবো।আর না হলে আমাকে একটা দিন দাও তোমাকে এত টাকা দিবো। সারাজিবন বসে খেতে পারবে। মাহিনের কথা বলা শেষ হতে না হতেই ভূমিকা ওর গালে চড় বসিয়ে দেয়। চড়টা এত জোরে দিয়েছে যে সেই শব্দটা দিগন্ত ওর তার বন্ধুরাও শুনতে পেয়েছে। মাহিন এক গালে হাত রেখে ক্রোধান্বিত হয়ে ভূুমিকার দিকে তাকাতেই, ভুমিকা মাহিনের আরেক গালে চড় বসিয়ে দেয়। তারপর চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
-আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার। শুনুন আমরা গরীব হতে পারি তবে এটাও গরীব নয় যে নিজের সম্মান বিক্রি করে দিবো। আমাদের সম্মানটাই সম্বল। এটা নিয়েই গর্ব করে বেঁচে থাকি আমরা।আর আপনি আমার সম্মান বিক্রি করার কথা বলছেন।
-কি হচ্ছে এখানে?? দিগন্তের কথায় ভূমিকা ও মাহিন দুজনেই পিছনে তাকায়।দিগন্তকে দেখে মাহিন গালে হাত দিয়ে দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-কাজের লোক দিয়ে এভাবে অপমান করাবি। আগে জানলে কখনোও আসতাম না। মাহিনের কথা শুনে দিগন্ত ভূুমিকার দিকে তাকালো। ভূমিকা অসহায় মুখ নিয়ে দিগন্তের মুখ পানে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ভূুমিকার শরীর হাত পা কাঁপছে।
-কি হয়েছে ভূমি?? দিগন্তের শান্ত বাক্য শ্রবণ করেই এক টুকরো আশার আলো খুজে পায় ভুমিকা। মনে মনে এক অদ্ভুত সাহসের সুচনা হতে থাকে। তখনি মাহিন বলে উঠে,
-ওই মেয়েটা কি বলবে দিগন্ত, আমি বলছি।দিগন্ত মাথা ঘুড়িয়ে মাহিনের দিকে তাকায়। তখন মাহিন বলে,
-একটা কাজের মেয়ের কথা শুনে তুমি আমার জার্জ করবি?? কাজের মেয়ে হয়ে আমার গায়ে হাত তুলল আর তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস। মাহিনের বাকি বন্ধুরা তাকিয়ে আছে দিগন্তের মুখের দিকে। তারা মাহিন কে ভালো করেই চেনে। ওর ওভার এক্টিন সম্পর্কে সবাই অবগত। তাই তো সবার দিগন্তের মতামতের অপেক্ষা করছে। দিগন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে ভূুমিকার দিকে। আচ্ছা ফাজিল মেয়েতো। মুখে কি সুপারগ্লু লগিয়ে রেখেছে নাকি। স্টুপিড মেয়ে একটা। দিগন্ত বুঝতে পারছে ভূমিকা এখন কিছু বলতে পারবে না। তাই সে নিজেই বলে উঠলো,
-মাহিন, ভুমির কাছে ক্ষমা চা। ভূমিকা চোখ বড়বড় করে দিগন্তের দিকে তাকালো। ভূমিকা ভাবতেও পারেনি দিগন্ত এমন একটা কথা বলবে।
-হোয়াট, আমি ক্ষমা চাইবো তাও আমার একটা কাজের মেয়ের কাছে। ইম্পসিবল।
-পসিবল, সব ই পসিবল মাহিন। ভালোই ভালোই ক্ষমা চেয়ে নি। আমরা সবাই জানি তুই কিছু একটা করছোস। আর তুই তো ভালো করেই জানিস দিগন্ত কোন মেয়ের অস্মান করে না। হোক সেটা কাজের মেয়ে । [তপু]
তপুর মুখে কাজের মেয়ে শব্দটা শুনে ভূমিকা ছলছল দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকালো। দিগন্ত ভূমিকার চাহনি উপেক্ষা করে মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-এখনো দাঁড়িয়ে আছিস যে, ক্ষমা চাইতে বললাম না তোকে।
-সামান্য একটা কাজের মেয়ের জন্যে আমাকে অপমান করছিস। আগেই বলতে পারতি আসতাম না তোর বাসায়। বলেই ভূমিকার দিকে ক্রোধান্বিতা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাহিন। তারপর হনহন করে বেড়িয়ে যায় দিগন্তের বাসা থেকে। তপু, ইভান সবাই এক এক করে প্রস্থান করে।
নিজের রুমে ফ্লোরে বসে কাঁদছে ভূমিকা। এতটা অপমান সে আগে কখনও হয়নি।হ্যা দিগন্ত তাকে স্ত্রী হিসাবে মানে না। তাই বলে কাজের লোকের পরিচয় দিবে। স্ত্রী পরিচায়টা দিলে কি এমন ক্ষতি হতো। তাহলে তো মাহিন এত খারাপ কথাগুলো বলতে পারতো না। ওকে বাজে প্রস্তাব দিতে পারতো না। উল্টে দিগন্তের বউ হিসাবে ওকে সবাই সম্মান করতো। দিগন্ত কি সত্যিই তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় টেরই পায়না ভূমিকা। এদিকে ডিনারের সময় ভূমিকাকে ড্রাইনিং রুমে দেখতে না পেয়ে ভূমিকার রুমে আসে দিগন্ত। আজ সারাদিনের কাজে ভীড়ে ঠিক মতো খাওয়া হয়নি ভূমিকার। তার উপর মাহিনের বাজে ব্যবহার। দিগন্ত ঠিক করলো সে মাহিনের হয়ে ভূমিকার কাছে মাফ চাইআে। রুমে এসে ভূমিকাকে এভাবে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে দেখে দিগন্তর রাগ হয় বেশ। আচ্ছা ফাজিল মেয়েতো। বিছানা থাকতে ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এই মেয়ের কোন কান্ডঞ্জান নাই নাকি। ডিনার না করেই ঘুমিয়ে আছে। এই ভূমি, ভূমি,,,
দু-বার ডাক দিতেই চোখ আখি খুলে ভূমিকা। টেনেটুনে শাড়ি ঠিক করে সোজা হয়ে বসে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে,
-কিছু লাগবে আপনার??
-এখানে এভাবে ঘুমিয়ে আছো কেন?? রুমে এত বড় বিছানা থাকতে ফ্লোরে শুয়ে আছো কেন??
-কাজের লোকেদের এত নরম বিছানায় মানায় না।তাদের জন্যে ফ্লোরটাই ঠিক আছে। দিগন্ত বুঝতে পারলো ভূমিকা তার উপর রেগে আছে। সকলের সামনে কাজের লোকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বলে ভূমিকার মান বেড়েছে। ঠোট কামড়িয়ে উপর দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিলে দিগন্ত তারপর বলল,
-ডিনার করে নাও।
-আপনি মেয়ের খুব সম্মান করেন তাইনা। শুধু আমার বেলায়তেই কেন নয়??
-মেয়ে হিসাবে তোমাকে যথেষ্ট সম্মান করি ভূমি। বাট স্ত্রী সম্মান আমার থেকে কখনো এক্সপেক্ট করো না।
-কিন্তু কেন?? মানছি বিয়েতে আপনার মত ছিলো না। আমার দোষটা কোথায়??
-তোমাকে আগেই বলেছি আমি তোমাকে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। বন্ধুদের সামনে তোমাকে নিজের স্ত্রী বলে স্বীকার করলে সেটা অবশ্যই মিমির কান পর্যন্ত পৌঁছাতো। একথা মিমি শুনলে ও হয়তো সুইসাইড ও করতো পারে। আর আমি কোন অবস্থায় মিমিকে হারাতে পারবো না। কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় দিগন্ত। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ডিনার করে বিছানায় ঘুমাও। আমাকে বের হতে হবে। আর হ্যাঁ কোন অবস্থাতেই বাহিরে বের হবে না। ভূমিকা মাথা নাড়িয়ে দিগন্তের কথার সম্মতি জানায়। অতঃপর দিগন্ত চলে যায়।
দিগন্তের চলে যাওয়ার পর ভূমিকা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় চলে আসে। রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে ওই অন্ধকার আকাশের দিকে। যেখানে একটা চাঁদকে ঘিরে লক্ষ কোটি তারার মেলা। চাঁদের জ্যোৎস্না চারিদিকে সব কিছু ঝলঝল করছে। এই জ্যোৎস্নাময় রাতে একা দাড়িয়ে ভাবতে থাকে সেদিনের কথা। সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো। ভূমিকা বউ সেজেছিল বর এসেছিল, ভূমিকা মনে ছিলে ওর স্বামিকে নিয়ে নানা কল্পনা জল্পনা। চারিদিকে সকলের হৈচৈ। ভূমিকার বাড়িতে সবাই বর দেখার মেলা বসিয়েছিলো। বিয়ের আসরে যখন সবাই ভূমিকাকে কবুল বলার জন্যে তাড়া দিচ্ছিলে তখন ওর হবু বরের বাবা বলে উঠলেন,
-বিয়ে বন্ধকরুন। এই বিয়ে হবে না। চারিদিকে স্তব্ধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে।এই পিনপতন নিরবতায় মাঝে ভূমিকা খেয়াল করলো তার হবু বরের বাবার পাশে তার বাবা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ভূমিকা ছলছল দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকালো। ভুমিকার বাবার দু- চোখ পানিতে ছলছল করছে। কিন্তু কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না ভুমিকা।খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে ভূমিকার সাথে। কারন বাবারা সহজে কাদে না।
-যৌতুকের টাকা না দিতে পারলে এই বিয়ে হবে না। বিশ হাজার টাকা বের করার ক্ষমতা নাই, মেয়েকে আবার বড় ঘরে বিয়ে দিতে চাইছেন। রাকিব উঠে আয়।হবে না এই বিয়ে। ভূমিকার হবু বর তার বাবার কথায় বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভূমিকার বাবা তাদের হাত পায়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকে। যাতে তারা এই বিয়ে ভেঙে চলে না যায়। নিজের শেষ সম্বল দিয়ে মেয়ের বিয়ের যোগাড় যন্ত্ করেছিলেন তিনি।এখন যদি বিয়েটাই ভেঙে যায় তাহলে অর্থিক ও মানুষিক ভাবে শেষ হয়ে যাবেন তিনি। তাছাড়া আমাদের সমাজ বড়ই নিঠুর, এই সমাজে বিয়ে ভাঙা সংসার ভাঙা, বিধবা মেয়েদের স্থান সর্ব নিম্ন। এখন বিয়ে ভেঙে গেলে ভূমিকার ভবিষ্যৎ এর কি হবে। সমাজ তাকে কোন চোখে দেখবে। আধো কি এই সমাজে জায়গা হবে ভূমিকার।নাকি সমাজ তাকে কলঙ্কিত নারী উপাধি দিবে।অথচ ইসলাম যৌতুক কে না করেছে। ইসলামের প্রথা অনুযায়ী ছেলে পক্ষে হতে কনের জন্যে দেনমোহর ধার্য করেছে। প্রত্যেকটা স্বামি তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহর দিয়ে তবেই তাকে স্পর্শে করতে পারবে। তবে যদি স্ত্রী স্ব ইচ্ছায় তার স্বামির দেনমোহর মৌকুফ করে দেয় সেটা অন্য বিষয়।
যৌতুকের কারনে আমাদের দেশের শতশত মেয়ে বিয়ের পর ফিরে আসছে তার বাবা বাড়ি। আবার কেও কেও সুইসাইড এর মতো পথ বেছে নেয়।প্রত্যেক বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দেয়, বিক্রি করে না। তার জন্যে ধর দামের কেন প্রয়োজন হয়।এটাই বুঝতে পারে না ভূমিকা। ভূমিকা অসহায় চোখে তার বাবার দিকে তাকালো। তিনি তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো যৌতুকের টাকা যোগার করতে না পারার কারনে সংকোচ বোধ করছেন। ভূমিকা ধীর পায়ে তার বাবার পাশে দাঁড়ায় গিয়ে। তারপর তার হাতে হাত রেখে বলে,
-তুমি ওনাদের চলে যেতে দাও বাবা। আমি এই বিয়ে করবো না।
-এসব তুই কি বলছিস মা। বিয়ে করবি না মানে। ওনারা চলে গেলে তোর কি হবে বুঝতে পারছিস??
-হ্যাঁ বাবা। আমি সব বুঝতে পারছি, কিন্তুু কি বলোতো বাবা। যারা ছেলের বিয়ে দিতে এসে দরদাম করে তাদের বাড়ির ছেলেকে বিয়ে করে সংসার করবো কি করে। বিয়ের পর এরা যখন বলবে তোমার বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসো। তখন কি হবে, আমার বাবা তো টাকা দিতে পারবে না। তখন যে এরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে না তার কোন গ্যারান্টি আছে বাবা।
ভূমিকার কথার কি জবাব দিবে তার বাবা। মেয়েটা তো সত্যিই বলছে। এমটা তো হতেই পারে। তিনি মুদ্ধ চোখে তার মেয়েকে দেখছে। কতটা বড় হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে।মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন ভূমিকার বাবা। ভূমিকা মৃদু হেসে বলল,
-আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না বাবা। আমি মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। শারিরিক শ্রম নাই দিতে পারি। আমার বাবার মতো মানুষিক শ্রম দিয়ে নিজের ব্যাবস্থা করে নিবো। তুমি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ঞ্জান বিতরণ করবে। আর আমি বাড়িতে বসে করবো। দরিদ্রকে যারা অবহেলা করে তাদের বিয়ে করার কোন প্রশ্নই উঠে না। ভূমিকার কথায় তার বাবা হেসে উঠলো। আর হবু বরের বাড়ির সকল আত্নীয় অপমানে রাগে চলে যায় বিয়ের আসর থেকে। যাওয়ার আগে বলে, আমরাও দেখি এমন বেয়াদব মেয়ে কার বাড়ির বউ হয়। এই মেয়ে যার সংসারে যাবে তার সংসার একদম শেষ হয়ে যাবে। বড়দের এই এক সমস্যা, তাদের কথার মুখ্য জবাব দিলেই বলবে বেয়াদব। তাতে ভূমিকার কিছু যায় আসে না। সে কারো কথার কর্ণোপাত করলো না। সবাই চলে যাওয়ার পর ভূমিকা বাড়িতে চলছে পিনপতন নিরবতা।
ভূমিকার বিয়েতে উপস্থিত ছিলো ওদের গ্রামের চেয়ারম্যান মাশহুদ তালুকদার। বিয়েতে তিনি ভূমিকার বাবাকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছেন। তাই ভূমিকার বাবার অনুরোধে তিনি এসেছেন। সে বিয়ের আসরের এক কোনে দাঁড়িয়ে ভূমিকার কথা শুনছিলেন। আর ভূমিকাকে বিচক্ষণ করছিলেন। ভূমিকার কথা আর ওর সিদ্ধান্ত দেখে মুদ্ধ হন তিনি।এমন একটা মেয়েই তো চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য। মাশহুদ ঠিক করে ফেললেন এই মেয়েকে তিনি তার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন। ভূমিকাই হবে চেয়ারম্যান বাড়ির যোগ্যবউ।
বিয়ের বাড়ির পিনপতন নিরবতা ভেঙে মাশহুদ তালুকদার বলে উঠলেন,
-বিয়া ওইবো। মাস্টার মশাই আপনার মেয়ের বিয়া ওইবো, এবং আজই ওইবো। চেয়ারম্যানের কথা শুনে সবাই শকড্। বিয়ে হবে মানে কি। বর ছাড়া বিয়ে হবে নাকি। চেয়ারম্যান তার চেলা সোনামিয়াকে ডেকে বললেন,
-দিগন্তকে ডাকো।
-দিগন্তকে ডেকে কি করবেন??
-দিগন্তের সাথে মাস্টার মশাইয়ের মাইরার বিয়া ওইবো। ওকে যেখানে পাও যে অবস্থায় পাও ধইরা নিয়া আসো। আজ এই আসরেই দিগন্তের লগে ভূমিকার বিয়া ওইবো।
-এটা আপনি ঠিক করছেন না চেয়ারম্যান সাহেব। দিগন্ত বাবাজি এখনও ছোট। ওর এডুকেশন এখনও শেষ হয়নি আর আপনি ওর বিয়ের কথা বলছেন??
-পড়ালেখা বিয়ার পরেও করবার পারবো। কিন্তুু এমন রত্ন হারিয়া গেলে আর পাওন যাইবো না। যাও দিগন্তকে ধইরা নিয়ে আসো। অতঃপর সোনামিয়া চলল দিগন্তকে ডাকতে।
প্রায় আধঘণ্টা পর সোনামিয়া দিগন্তকে নিয়ে বিয়ে বাড়ি উপস্থিত হয়। বেচারা মনে হয় ঘুমিয়ে ছিলো চোখ মুখ কেমন ফুলা ফুলা লাগছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। টি শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে কুচি ধরে আছে। দিগন্ত বুঝতে পারেনা তাকে এইভাবে ধরে আনার কারন কি? উহঃ কি সুন্দর ঘুমাচ্ছিললাম। আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এখানে নিয়ে আসলো।
-কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু কইরা দেন। আমার পুত এইসা পড়ছে। চেয়ারম্যানের কথা শুনে বিষম্মের দৃষ্টিতে তাকায় দিগন্ত।
-এক মিনিট আব্বা। বিয়া পড়াইবো মানে। কার বিয়া??
-তোর আর মাস্টার মশাইয়ের মাইয়ার বিয়া। খুব ভালো মেয়ে বুঝলি দিগু। এক্কেবারে চেয়ারম্যান বাড়ির যোগ্যবউ। বলেই অট্টহাসি দিলেন চেয়ারম্যান। দিগন্তের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সে তো পারবে না এই বিয়ে করতে। সে যদি বিয়ে করে তাহলে মিমির কি হবে।সে তো মিমিকে কথা দিয়েছে।এখন বিয়ে হলে মিমির কি হবে। মিমি এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না।
-আমি এই বিয়া করতে পারুম না আব্বা।
চেয়ারম্যান মৃদু হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল।
-বাচ্চা মানুষ। পড়াশুনা এখনও শেষ হয়নাই। শহরে থাইক্যা পড়াশুনা করে তো।তাই শহরের মতো হইয়া গেছে।এখন বিয়া করতে চাইছে না। আমার পোলা কিন্তু পড়াশুনায় একশো তে একশো।
-আব্বা আপনি আমার কথা শুনেন।
-এখন তোর কথা শুনোনের টাইম নাই। আগে বিয়াটা হোক তারপর শুনবো। দেখ কত দেরী হইয়া গেছে। কাজি সাহবে জলদি বিয়া পরানো শুরু করেন।
-আমারে মাফ করেন আব্বা। আমি এই বিয়া করুম না।
- তুই করবি না তোর বাপ বিয়া করবো। বস ওখানে।
-তাইলে আফনেই করেন বিয়া। আমি আম্মারে নিয়া ঢাকায় চইলা যাইতাছি। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই চেয়ারম্যান তার চেলা পেলাগো চোখের ইশারায় দিগন্তকে আটকাতে বলে। যার ফলো চেয়ারম্যানের চেলারা দিগন্তকে আটকিয়ে বিয়ের আসরে বসিয়ে দেয়।
দিগন্তের ঘরে বউ সেজে বসেআছে ভূমিকা। হ্যাঁ ওদের বিয়েটা হয়েগেছে। চেয়ারম্যান বাড়ির সকলেই ভূমিকাকে বউ হিসাবে মেনে নিয়েছে। মানতে পারেনি শুধু দিগন্ত। দিগন্তের মা হাসি মুখে ভূমিকাকে বরণ করে ঘরে তুলে। ভূমিকাকে রেখে সেই চলে গেছে দিগন্ত এখনও বাড়ি ফেরার কোন নাম নেই। ভূমিকা দিগন্তের পুরো ঘরটাকে নিরক্ষণ করেনিলো। পুরনো ডিজাইনের একটা খাট। তার পাশে একটা পড়ার টেবিল।টেবিলের উপর বইয়ের পাহার। তার উপর দেয়ালে টানানো আছে কঙ্কালের ছবি, ব্যাঙের ছবি। আরো ছোট ছোট কয়েকটা কাগজ। খাটের অপজিট পাশে একটা আলমারি আর একটা ড্রেসিংটেবিল দিয়েই সাজানো হয়েছে দিগন্তের ঘরটা।পুরো ঘরটা দেখা শেষ ভূমিকার চোখ পড়লো দেয়ালের উপর সাঁটানো ঘড়ির দিকে। রাতের প্রায় এগারোটা বাজতে চলল অথচ দিগন্ত আসছে না তার ঘরে। ভূমিকা বিছানায় বসে দিগন্তের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।ভূমিকা তার দাদী নানীর মুখে শুনেছে, বাসর রাতে নাকি স্বামিকে সালাম করতে হয়। তারপর তাকে পান দুধ খাওয়াতে হয়। বাসর ঘর না সাজালেও পান আর দুধ ঠিকই রেখেছে। কিন্তুু এগুলো খাওয়াবে কাকে। দিগন্ত তো তার ঘরে আসে নি। তাই বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো ভূমিকা ।
আযানের শব্দে ঘুম ভাঙে ভূমিকার। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। আখি খুলতেই সে নিজেকে একটা অপরিচিত ঘরে দেখতে আবিষ্কার করে। সদ্য ঘুম থেকে বুঝতে পারেনা সে কোথায় আছে। পরক্ষনেই মনে পড়ে কালকে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। সে তো তার স্বামির জন্যে জন্যে অপেক্ষা করছিলো। ওহ শিট, সে ঘুমিয়ে পড়ছিলো। এটা ঠিক হয়নি। দিগন্ত কি ভাবছে এখন। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেল সে যে অবস্থায় ঘুমিয়েছিল ঘরটা সে রকমই আছে। লাইটটাও এখনও জ্বালানো, তাহলে কি দিগন্ত আজ বাড়ি ফিরে নি। তাহলে কোথায় আছে দিগন্ত।
সমস্ত ভাবনা চিন্তা বাদদিয়ে ওয়াশরুমে চলল ভূমিকা। আযান দিয়েছে। অজু করে নামায পড়ে নিল। এখন কি করবে। সকাল হতে এখনও কিছু সময় বাকি আছে। ওর বাড়িতে থাকলে এই সময় বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতো।এখানে তো কোরআন নেই তাই রুমটা গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ভূমিকা। সূর্য উদয়ের সময়টা মনে হয়সারাদিনের সব থেকে বেস্ট সময়। অন্ধকারের রেশ কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠা। মোরকের ডাকে সকলের ঘুম ভেঙে বাহিরে দাঁড়ালেই দেখতে পাওয়া যায় কিভাবে পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে চলছে। সকালের মিষ্টি রোদ বেশ উপকারি।
সকাল দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দিগন্ত। ভূমিকা তখন সকলের জন্যে চা বানাচ্ছিল। দিগন্তকে দেখেই ভূমিকার বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠে। এ কেমন অবস্থা হয়েছে তার। মনে হচ্ছে সারা রাত না ঘুমিয়ে কান্না করছে।ভূমিকা তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে কিন্ত সেদিকে দিগন্তের কোন খেয়ালই নেই। বাড়ি ফিরো কারো সাথে কোন কথা না বলে সোজা চলে যায় তার ঘরে। এবং সেখানে গিয়ে নিজের সমস্ত জিনিসপত্র প্যাকিং করতে থাকে।
#বেলা_শেষে। [০৩]
ব্যাগ প্যাকিং করে খাটের এক পাশে রেখে অন্যপাশে বসে আছে দিগন্ত। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। বাড়ি থেকে চলে যাবে বলে ব্যাগ তো প্যাকিং করে নিলো। কিন্তুু বের হবে কি করে? মাশহুদ তালুকদারকে জমের মতো ভয় পায় সে। সে যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় । তখন কি করবে দিগন্ত। সে তো কিছুতেই যেতে পারবে না।বাবার কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্যি তার নেই। দুহাতে কপাল চেপে ধরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলো দিগন্ত। ওর উদ্দেশ্য মাশহুদ তালুকদার যখনি বাড়ি থেকে কোথাও যাবেন তখন দিগন্ত কাওকে কিছু না বলে চলে যাবে। ঢাকায় পৌঁছে গিয়ে তার মাকে কল করে জানাবে।
মাশহুদের হাতে চা দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ভূমিকা। মাশহুদ চায়ে এক চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধকরে চায়ের স্বাদ উপভোগ করে নিলেন। তারপর মৃদু সূরে ডাক দিলেন,
-বৌমা,,,,
ভূুমিকা পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মাশহুদ আবারও বলে,
-দিগুটা সেই কখন তার ঘরে ডুকলো। এখন পর্যন্ত বাইরে বের ওইলো না। তুমি ওর কাছে যাও। জিগ্যাও গিয়া কিছু লাগবো নাকি? মনে হয় আমার উপর রাইগা আছে। জোর করে বিয়া দিছি তাই নিগ্যা। ভূমিকা মাথা নাড়ায়। তারপর হাতে এক কাপ চা নিয়ে চলে আসে দিগন্তের ঘরে। দিগন্ত তখন দু- হাতে মাথা চেঁপে বসে ছিলো। ভূমিকা দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-আপনার কি মাথা ব্যথা করছে? ভূমিকার কন্ঠে শ্বর শুনে মাথা থেকে হাত নামিয়ে সামনে তাকায় দিগন্ত। অতঃপর ভূমিকা বলে,
-আমি অনেক ভালো মাথা ম্যেসেজ করতে পারি। আপনার মাথা টিপে দিবো।
ভূমিকার কথাগুলো দিগন্তের কাছে নেকামো ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। বেশ তিক্ত লাগছে তার। শক্তচোখে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-বউ বউ আচরন করছো মনে হচ্ছে।
-এমা, বউয়ের মতো আচরন কেন করবো। আমি তো বউ ই তাইনা। ফটাফট কথা বলা ভূমিকার ছোট বেলার স্বভাব। ভূমিকার কথা শুনে কপালে ভাজ ফেলে ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো দিগন্ত। মেয়েটা বেশ চঞ্চল এটা আগে শুনেছে কিন্তুু কতটা চঞ্চল হতে পারে সেটাই ধারনা করতে ব্যাস্ত এখন দিগন্ত।
-এই মেয়ে শুনো, আমার সাথে একদম নেকামো করবা না বলে দিলাম। আর হ্যাঁ ভুলেও আমার বউ হওয়ার চেষ্টা করো না। আমি মানি না এই বিয়ে।
-পরে মানিয়ে নিবেন।
এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না দিগন্ত। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভূমিকার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে সেটা ফ্লোরে ছুঁড়ে দিলো। আচমকা চায়ের কাপে হাত দেওয়ার কারনে কিছুটা চা ভূমিকার হাতে পরে। কিন্তুু সেদিকে খেয়াল নেই ভূমিকার। তার দৃষ্টি এখন সামনে থাকা এই যুবকটার দিকে। কেমন ছেলে এটা একটু কথাই রাগ করে। অথচ ভূমিকা জানে ছেলেরা যেমন সহজে কাঁদে না। আবার রাগও করে না। কিন্তুু এই ছেলে সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী আচরণ করছে।কথার কথায় রাগ দেখাচ্ছে আবার বিয়ে মানে না বলছে। বলুক তাতে কি যায় আসে। বিয়ে তো হয়েগেছে। ভূমিকা খেয়াল করলো দিগন্ত তার হাত শক্তমুঠি করে নিয়েছে। রাগে ফুসছে আর ঠোঁট কামড়াচ্ছে। ভূমিকার কেন যানি মনে হলে ব্ল্যাক মাম্বা সাপের মতো লাগছে দিগন্তকে। আচ্ছা সে কি এখন সাপের মতো ভূমিকাকে ছোবল দিবে। ঘাড় বাকা করে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো ভূমিকা।
-এই মেয়ে, এই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন হুম? ছেলে দেখনি কখনো??
ভূমিকার বলতে ইচ্ছে করছে, ছেলে আর বর এক হলো নাকি। আমি তো আমার বর কে দেখছি আপনি বাধা দিচ্ছেন কেন? কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করার সাহস হলো না ভূমিকার। দিগন্ত যে পরিমান রেগে আছে এখন কিছু না বলাই বুদ্ধিমতীর কাজ।
হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর ফ্লোরে পরে থাকা ভাঙা চায়ের কাপের দিকে তাকানোর সময় বিছানায় দুটো ব্যাগ দেখতে পেলো। তার মধ্যে একটা জামা কাপড়ের ব্যাগ আর অন্যটাতে হয়তো ল্যাপটপ আছে। কিন্তুু দিগন্ত তার জামা কাপড় প্যাকিং ই বা করছে কেন?? গভীর প্রশ্ন ভূমিকার। নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে ভূমিকা আবারও তার মুখ খুলল,
-আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন??
-তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি???
-আমি আপনার স্ত্রী আমাকে বলবেন না তো কাকে বলবেন???
ভূমিকার বলা কথায় নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পাড়লো না দিগন্ত। দুহাতে ভূমিকার বাহু চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বলল,
-এনাফ ইজ এনাফ। আর এক বার যদি নিজেকে আমার বউ হিসাবে উল্লেখ করছো তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেও হবে না। বুঝেছো। আমি মানি না এই বিয়ে। তোমাকে বউ হিসাবে মানি না। আমার বউ হবে তো মিমি। আমার মিমি।
মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়েগেলো ভূমিকা। দু-চোখের সামনে কেমন যেন সব কিছু ঝাপসা লাগছে। দিগন্তের বলা শেষ কথাটা এখনও ভূমিকার কানে বাজছে, আমার বউ হবে মিমি। আমার মিমি। দু- চোখ বন্ধকরে নিলো সে। বেশ গরম হাওয়া বয়ছে। হয়তো এক্ষুনি ঝড় উঠে আসবে। তারপর জড়ানো গলায় বলল,
- কে মিমি?
দিগন্তের হুস আসলো। সাথে সাথে ভূমিকাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে দাঁড়লো। রাগের বসে কি সব বলেছে সে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বড় করে শ্বাস নিলো।
-আমাকে সবটা বলতে পারেন। সাধ্যি থাকলে আপনাকে সাহায্য করবো? নিজের সুখের জন্যে অন্যকারো সুখ কেড়ে নেওয়ার অধীকার আমার নেই। আপনি কোন সংকোচ না করে আমাকে সত্যিটা বলতে পারেন। ভূমিকার কথা শুনে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় দিগন্ত। ভূমিকাকে কি সব সত্যি বলে দিবে। হ্যাঁ বলে দেওয়াই ভালো। পরে এই নিয়ে আর কোন কথা বলতে পারবে না সে। অতঃপর দিগন্ত বলতে শুরু করে,
-মিমি হলো আমার গার্লফ্রেন্ড। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নিয়েছি। কিন্তুু তার আগেই আব্বা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। এখন মিমি যদি জানতে পারে আমি বিয়ে করেছি তাহলে ও নিজেকে শেষ করে দিবে। কি করবো বুঝতে পারছি না।
-এ কথা আগে বলেন নি কেন??
-বলার সুযোগ দিয়েছে কেও আমাকে। জল্লাদের মতো সবাই আমাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলো।
ভূমিকা বড় করে শ্বাস ছাড়লো। তারপর বলল,
-আমি আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি। অতঃপর দিগন্ত তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলল। ভূমিকা সেটাও মেনে নেয় এবং বলে সে এদিকের সবটা সামলে নিবে।
সেদিন রাতে ভূমিকার সাহায্যেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় দিগন্ত। মাশহুদ ভূমিকার কাছে দিগন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভূমিকা জবাব দেয়। সে সবটা জানে। আর দিগন্তের কলেজ থেকে ফোন এসেছিল। তাই সে কাওকে কিছু না বলেই চলে গেছে।
দিগন্ত চলে যাওয়ার দুই মাস পর্যন্ত ভূমিকার সাথে কোন রকমের যোগাযোগ হয়নি। ভূমিকাও আগ বাড়িয়ে দিগন্তের সাথে যোগাযোগ করে নি। যেখানে সম্পর্ক থাকবে কি না তার কোন নিশ্চয়তা নেই সেখানে মায়া বাড়িয়ে নতুন সম্পর্ক তৈরী করারও কোন মানে নেই। এদিকে ভূমিকার রেজাল্ট ও বের হয়েছে। বরাবরের মতোই এবারও ভালো রেজাল্ট করেছে ভূমিকা। সেই খুশিতে চেয়ারম্যান পুরো গ্রাম মিষ্টি বিতরণ করেন।চলে যায় সময় দিগন্তের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছেদ এখন ভূমিকার। ভূমিকা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। বাকি সব মেয়েদের মতো সে সমাজকে নিন্ম স্তরে পরে থাকবে না। সে প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের একজন সু-প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে সমাজে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মেয়েরা একা বাঁচতে পারে না এই প্রথা ভূল প্রমানিত করবে সে।
ভূমিকা তার লক্ষের পথেই এগোতে থাকে। আর এই সিদ্ধান্তে তার পাশে দাঁড়ায় তার শ্বশুড় মশাই মাশহুদ তালুকদার। মাশহুদ ভূমিকাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট করে। যদিও এই কাজে দিগন্তের মা বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিন্ত মাশহুদের সিদ্ধান্তের কাছে তার কথা টিকে থাকে না। মাশহুদ ভূমিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-আমাদের এই কুলষিত সমাজ কে প্রমান করে নারীরা চাইলে সব করতে পারে। যে রাধে সে চুলও বাধে।
ভূমিকার বিয়ের তিন মাস চলছে। এখন সামনে ইলেকশন। মাশহুদ তালুকদার সেই নিয়ে ব্যাস্ত। যদিও ইলেকশন হতে আরো দু মাস সময় আছে। তবুও প্রিপারেশন বলে একটা কথা আছে। আজ সকালে বেলা মাশহুদ দিগন্তকে কল করে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসতে। তিনি একা একা সব সামলাতে পারছে না।
বিকাল বেলা দিগন্তের চাচাতো বোন অদিতি এসে ভূমিকাকে বলে,
-ভাবি তুমি ভাইরে আইতে কও না কেন? নতুন বউ রাইখা কেও এত দিন দূরে থাকে। অদিতির কথা স্মিত হাসলো ভূমিকা। অদিতি মেয়েটা বড্ড সরল। সব সময় মুখে কথার ফুয়ারা ফুটে কিন্তু পড়ালেখায় ঘোড়ার ডিম। চার বছর ধরে ক্লাস এইটে পরে আছে। একবার একটা স্যার ওকে টুকলি করতে বলেছিলো। যাতে পাশ করে ক্লাস এইট পার করতে পারে। কিন্তু অদিতি যে অতি সৎ। সে কিছুতেই টুকলি করবে না। দরকার পরলে আরো চার বছর ক্লাস এইটে পড়বে। কিন্তু টুকলি করবে না।
-ভাবি তুমি ভাইরে চিঠি লেখো না ক্যান??
-তোমার ভাইয়ের চিঠি পড়ার সময় নেই। সে পড়াশুনা নিয়ে খুব ব্যাস্ত।
-আইচ্ছা। তারপর অদিতি আর ভূমিকা মিলে অনেক গল্পকরে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে আকাশের ওই রুটির মতো চাঁদটাকে দেখছে। চাঁদের জ্যোৎস্নায় চারিদিকে মো মো করছে। পুরো গ্রাম স্তব্ধ। পৃথীবিতে রাত নামার সাথে সাথেই ক্লান্ত এই গ্রাম ঘুমিয়ে পরে। হঠাৎ করে বেল বাজার শব্দ শুনতে পায় ভূমিকা। কিন্তু এত রাতে কে আসলো সেটাই বুঝতে পারে না সে। এদিকে লোকটা বিরতিহীন ভাবে বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। ভূমিকার ইচ্ছে করছে লোকটার হাতে চাপট মারলে। উহ কান ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে এসে দরজা খুলে দেয় ভূমিকা। দরজার ওপাশে ব্যাক্তিকে দেখে ঠায় দাড়িয়ে থাকে সে।
#বেলা_শেষে। [০৪]
-আপনি এখানে?? ভূমিকার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন শুনে দরজার ওপাশে থাকা লোকটি জবাব দিলো,
-এ্যনি প্রবলেম??
- না, প্রবলেম হবে কেন? আপনার বাড়িতে আপনি আসবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
-তাহলে পুলিশের মতো জেরা করছো কেন?? বলেই ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো দিগন্ত। ভূমিকা ভেংচি কেটে দিগন্তকে ব্যঙ্গ করে বলল,
-পুলিশের মতো জেরা করছো কেন?? চোরেরে মতো গভীর রাতে বাড়িতে আসলে তো পুলিশের মতো জেরা করবোই। যত্তসব।
দিগন্তের সাথে এক বিছানায় থাকতে হবে ভাবতেই গা সিউরে উঠছে ভূমিকার। এই তিনটা মাস তো সে তার নিজের ইচ্ছেমত ছিলো। যখন খুশি ঘুমিয়েছে, পড়ছে গান গায়ছে। রুমের অন্যকেও থাকলে নিজের স্বাধীন মতো চলা যায় নাকি। পরাধীনতা মেনে নিতে পারবে না ভূমিকা। তাও আবার দিগন্তের জন্যে তো নয়। যার সাথে তার কোন রকমের সম্পর্ক নেই তার সাথে একই ঘরে একই বিছানায় থাকার প্রশ্নই উঠে। ওদের সম্পর্ক তো শুধু কাগজে কলমে। ফিজিক্যালি ওদের কোন সম্পর্ক নেই। পুরো ঘরে পায়চারি করছে আর ভাবছে।
দিগন্ত ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল দিয়ে মাথার মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বাহিরে আসে। ভূমিকাকে এভাবে পায়চারী করতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় তার দিকে। ভূমিকা বিরবির করে কিছু বলছে আর পায়চারী করছে। মনে হচ্ছে হাই টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু দিগন্ত ভেবে পায়না ভূমিকার টেনশনের কারন কি? যাই নিয়ে টেনশন করুক তাতে দিগন্তের কি? বিছানার উপর টাওয়াল রেখে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে চিরুনি দিয়ে মাথার চুল আঁচড়াতে থাকে। তখন ভূমিকা কোমড়ে হাত দিয়ে দিগন্তের পাশে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে আয়নার দিগন্তের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। আয়নার মধ্যেই দিগন্তের সাথে ভূমিকার চোখাচোখি হয়। তখন ভূমিকা তার দৃষ্টি শক্ত করে ফেলে। দিগন্ত চিরুনি রেখে পিছনে ফিরে তাকায় আর বলে,
-এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার হ্যাঁ।এরকম উদ্ভট আচরণ কেন করছো??
-আপনি কোথায় শুবেন??
ভূমিকার প্রশ্নে তড়িৎগতিতে জবাব দেয় দিগন্ত,
-আমার বিছানায়।
-নাহ। আপনি এ ঘরে থাকতে পারবেন না। আমি কিছুতেই আপনার সাথে এক ঘরে থাকতে পারবো না।
-সেটা তোমার প্রবলেম। বলেই বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয় দিগন্ত। আর বলে, তুমি চাইলে ফ্লোরে শুতে পারো। বাট আমার বিছানায় জায়গা পাবে না।
-আরেহ আপনি তো চলে গিয়েছিলেন এখন আবার ফিরে আসলেন কেন? মহা মুশকিলে পরলাম তো। শুনুন?এই যে আপনাকেই বলছি, এমা ঘুমিয়ে পড়ছে। এখন কি করি? বিরক্তি মাখা মুখ করে বসে থাকে ভূমিকা।
সেদিন রাতটা জেগেই কাটিয়েছিল ভূমিকা। ভুলেও একটি বারের জন্যেও দু-চোখের পাতা এক করে নি ভূমিকা। পরের দিন সকালে জানতে পারে ইলেকশনের জন্যে গ্রামে এসেছে দিগন্ত। ইলেকশন শেষ হলে সে আবার চলে যাবে। তারপর থেকে প্রয়োজন ছাড়া কথা হতো না করোরই। দিগন্ত বেশীর ভাগ সময় বাড়ির বাহিরে কাটাতো। সকালে খেয়ে বেড়িয়ে যেত আর অনেক রাতে বাড়ি ফিরতো। রাতে দিগন্ত যখন বাড়ি ফিরতো ততক্ষণে ভূমিকা ঘুমিয়ে যেত।আর সে দিগন্তের রুমেই ফ্লোরে বিছানা পেতে শুতো। এদিকে ভূমিকার এডমিশনের ডেট ও চলে আসছে। ভূমিকা চায় সে ডিগ্রীতে ভর্তি হবে। তারপর ডিগ্রী কম্প্লিট করে এল এল বি করবে। কিন্তুু মাশহুদ তালুকদারের ইচ্ছে ভূমিকা ডিগ্রী নয় অনার্স করুক। তারপর ভালো কোন ইউনিভার্সিটিতে এল এল বি এর জন্যে এডমিশন করিয়ে দিবে। ভূমিকা সেটাই মেনে নেয়।কারন ডিগ্রীর থেকে অনার্স পড়াটা বেশী গুরুত্ব দেয় সবাই। তাই মাশহুদের কথা মতো অনার্সেই এডমিশন নেয় ভূমিকা। সব মিলিয়ে দুই মাস খুবই ব্যস্ততার সাথে কাটে তালুকদার পরিবারের।
এবারও বিপুল ভোটে মাশহুদ তালুকদার গ্রামের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। মাশহুদ তালুকদারের মতো লোককে সবাই পছন্দ করে। একজন নেতা হওয়ার সমস্ত গুনই তার মধ্য বিদ্যমান। নির্বাচন শেষে যেদিন দিগন্ত ঢাকায় চলে আসবে সেইদিন মাশহুদ দিগন্ত আর ভূমিকাকে ডেকে তার ঘরে নিয়ে যায়। খাটের উপর গম্ভীর মুখ করে বসে আছে মাশহুদ। তার সামনেই মাথা নিচুকরে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত আর ভূমিকা। দিগন্ত ভাবছে কোন কারনে মাশহুদ তার উপর রেগে আছে। কারন এটা সে ছোট বেলা থেকেই জেনে আসছে। ছোট বেলায় যখন দিগন্ত কোন অন্যায় করতো। তখন তিনি ঠিক এইভাবে গম্ভীর হয়ে বসে থেকে দিগন্তকে শাস্তি দিতেন। মাশহুদ দিগন্তকে খুব কড়া শাসন করতেন। যেটা আজ কালের বাবা মায়েদের মধ্যে নেই। এই জেনারেশনের বাবা মা তাদের সন্তানকে শাসন করার নাম করে তাদের দিগুণ আদরে ভরে দেয়। তাহলে এই সন্তায় বখে গেলে তার দায় তো বাবা মাকেই নিতে হবে তাইনা। মাশহুদ তালুকদারের এক কথা, আমি আমার সন্তানকে ভালবাসি খুব ভালবাসি। তাই আমি চাইনা আমার সন্তান মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে যাক। কারন আমি মানুষ জন্ম দিয়েছি। তাকে মানুষের মতো মানুষকরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বটাও আমাকেই নিতে হবে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুই- তৃতীয়াংশ হলো তরুণ।পশ্চিমা দেশ গুলোতে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন মাদক ব্যবহারকারী হলো তরুন। আমাদের দেশে মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণীর প্রকৃত সংখ্যা বলা কঠিন। কারণ এ বিষয়ে কোনো জাতীয় পরিসংখ্যান নেই। তবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের ০.৮ ভাগ মাদকাক্তির সমস্যায় ভুগছে। এটুকু বলা যায়, এ হার বাস্তব অবস্থার খণ্ডচিত্র মাত্র। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী যেকানো বয়সী মাদকাসক্তের এ সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি যাদের শতকারা ৮০ ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরেরে মধ্যে।আর এর প্রধান কারন হলো পারিবারিক শিক্ষা আর সু- শিক্ষার অভাব। যেটা মাশহুদ তালুকদার তার সন্তানকে দিয়েছে।
অপরদিকে ভূমিকা ভয়ে কাঁপছে। মাশহুদ তাদের কি এমন বলবে যে এভাবে আলাদা করে ডেকে আনলো। আচ্ছা বাংলা সিরিয়ালের শ্বশুড় শ্বাশুড়ির মতো তো বলবে না, আমি দাদা দাদু হতে চাই। মুখটা ভেটকালো ভূমিকা। এটা কখনও সম্ভব নয়। সকলের মৌনতা ভেঙে মাশহুদ একটা কাগজ বের করে সেটা ভূমিকার হাতে দিলেন। ভূমিকা কাগজের দিকে লক্ষ না করেই প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাশহুদের দিকে।
-আমি তোমার কলেজেই ভূমিকাকে ভর্তি করিয়েছি দিগু। এখন থেকে তোমরা এক সাথে থাকবে। মাশহুদের কথা শুনে দুজনেরই চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মাশহুদের দিকে। ভূমিকা জানতো শহরের নাম করা একটা কলেজে ভর্তি করিয়েছে তাকে। কিন্তু সেখানে দিগন্তও পড়ে এটা জানা ছিলো না ভূমিকার। আর দিগন্ত ভাবছে ভূমিকা ইচ্ছে করেই ওর কলেজে এডমিশন নিয়েছে যাতে ভূমিকা ওর কাছাকাছি থাকতে পারে। শক্ত চোখে ভূমিকার দিকে তাকালো দিগন্ত। ভূমিকা ইনোসেন্ট মুখ করে তাকাতেই দিগন্ত ওর হাত শক্ত করে নিলো।
মাশহুদ দিগন্তের হাতে একটা ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিলেন। সেটা ওদের দুজনের থাকার জন্যে কিনেছেন তিনি। তারপর ভূমিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-যাও মা, একজন সৎ ও কঠিন উকিল হয়ে গ্রামে ফিরবে।যে মিথ্যের ধমকা হাওয়ায় কখনো ভেঙে পড়বে না। রাবেয়া ভূঁইয়া ছিলেন আমাদের দেশের প্রথম মহিলা আইনজীবী। আর আমাইরা ভূমিকা তালুকদার হবে আমাদের গ্রামের প্রথম আইনজীবী। বলেই অট্ট হাসলেন মাশহুদ। এরপর অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ভূমিকাকে নিয়ে ঢাকায় আসতে হয় দিগন্তের।
নিজের ভাবনায় জগৎ থেকে বেড়িয়ে বড় করে শ্বাস ছাড়ে ভূমিকা। ঢাকায় চলে আসছে আজ দুদিন হলো। এখানে এসে দুজনে আলাদা রুম নিয়েছে। দরকার ছাড়া কেও কারো সাথে তেমন কথা বলে না। আজ দিগন্তের বন্ধুরা এসেছিলো তাই ভূমিকা নিজে হাতে ওদের জন্যে রান্না করছিলো। পিছনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে সে। সেখানে দিগন্ত বুকের উপর হাত গুজে শক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
-আ- আপনি কখন এলেন??
-এত কি ভাবছিলে তুমি??
- ক-কই কি- কিছু নাতো।
- কখন থেকে ডাকছি তোমাকে কোন রিসপন্স করছো না। আমি ভাবছি তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছো।
-একদম ফালতু কথা বলবেননা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেও ঘুমায় নাকি।
-কেন ঘোড়া ঘুমায়।
-কিহহহ, আমাকে দেখে কি আপনার ঘোড়া মনে হয়।
-আস্তে এত চেঁচাচ্ছ কেন?? কানে হাত রেখে বলল দিগন্ত। ঘোড়র মত দেখতে না হলেও স্বভাব চরিত্র ঠিক ঘোড়ার মতো। শেষ কথাটা বিরবির করে বললেও সেটা ভূমিকার কান পর্যন্ত পৌছায়।
-আর আপনি, আপনি কি হ্যাঁ। আপনি একটা কুমির কিন্ত আপনার স্বভাব জলহস্তীর মতো। রাগে কটমট করে বলল ভূমিকা
ভূমিকার রাগ দেখে ঠোট চেপে হাসলো দিগন্ত। এই মেয়ে খুবই অদ্ভুত। একটুতেই রেগে যায়। ভূমিকাকে রাগানোর জন্যে দিগন্ত আবার বলল,
-তবে যাই বলো দুটোই কিন্তু পানিতে থাকে। তোমার মতো মানুষ হয়ে ঘোড়ার মতো আচরন করে না
-আপনি, আপনাকে তো আমি, বলেই দিগন্তের পিছনে তাড়া করতে শুরু করলো। আর দিগন্ত ওর সামনে দৌড়াচ্ছে।
#বেলা_শেষে। [০৫]
সুফায় গুটিশুটি মেরে বসে দুহাতে কুশন জড়িয়ে রেখে টেলিভিশন দেখছে ভূমিকা। সাউথ ইন্ডিয়ান মুভির গান দেখছে। ভূমিকার ইচ্ছে করছে গানের তালে তালে ডান্স করার। ছোটবেলার এমন কতই না হতো। টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে একা একা ডান্স করতো সে। ছোট বেলার কথা মনে আসতেই মৃদু হাসলো। এদিকে দিগন্ত এক্কেবারে রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। ড্রয়িংরুমে এসে ভূমিকাকে এভাবে টেলিভিশন দেখতে দেখে দিগন্তের মেজাজ বিগড়ে গেলো। এক ঘন্টা আগে ভূমিকাকে রেডি হতে বলেছিলো সে। আজ ভূমিকার কলেজের ফাস্টডে। তাই একটু আগে যেতে চাইছিলো। কিন্তুু ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো ভূমিকার রেডি হওয়ার কোন নাম গন্ধই নেই। সে আয়েশ করে বসে টিভি দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে। ভূমিকার হাসির কারনটা বুঝতে পারলো না দিগন্ত। তাই সে ভ্রু কুচকিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকালো। সেদিকে তাকাতেই সে কাপলদের রোমান্টিক দৃশ্যবলি দেখতে পেলো। ওও আচ্ছা এই তাহলে হাসির কারন। তারপর ভূমিকার কাছে গিয়ে সুফার উপর থেকে রিমোট নিয়ে টিভি অফ করে দিলো। হঠাৎ করে টিভি অফ হয়ে যেতেই ভূমিকার মন খারাপ হয়ে যায়। আনমনেই বলে ফেলে,
-এখনি কারেন্ট যেতে হলো। কত সুন্দর রোমান্টিক গান হচ্ছিল। বলেই কুশন রেখে উঠে দাঁড়ায় আর তখনি দিগন্তের সাথে ধাক্কা খায়। ঘটনাক্রমে ভূমিকা সুফার উপর পরে যায় আর দিগন্ত সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
-জলহস্তীর মতো শরীর নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? ও মা আমার কোমড়টা মনে হয় ভেঙে গেলো।
-স্টোপ, আর একটু যদি সাউন্ড করছো তাহলে তোমাকে,,,,,
-কি? কি করবেন আপনি?? জলহস্তী একটা। বলতে বলতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ভূমিকা। দিগন্তের মুখোমুখি দাঁড়াতেই ওর হাতের দিকে চোখ পরে। ভূমিকা কোমড়ে হাত গুজে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-আপনি টিভি অফ করে দিয়েছেন??
-হ্যাঁ দিয়েছি তো??
-কেন? সুফায় বসতে বসতে বলল ভূমিকা।
-তোমাকে কখন বলছি রেডি হতে। আর তুমি এখানে বসে বসে রোমান্টিক গান শুনছো। যাও রেডি হয়ে এসো। ধমক দিয়ে বলল দিগন্ত।
-এই আপনার মাথায় কি আছে বলুন তো? ইচ্ছে করছে আপনার মাথা ফাটিয়ে দেখে নেই। আপনার মাথায় ভেতরে কি আছে। মগজ নাকি গোবরের পোকা। বিরক্তি মাখা মুখ করে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা।
- বড্ড বেশী কথা বলো তুমি। যাও রেডি হয়ে এসো। আমি ওয়েট করছি।
-আমি সিউর আপনার মাথা ভর্তি গোবরের পোকা। আপনি আমাকে কলেজে নিয়ে যাবেন। সেখানে তো আপনার বন্ধুরাও থাকবে তাদের কি বলবেন হুম। আপনি এতটাই উদার মনের মানুষ, যে কাজের মেয়েকে কলেজে নিয়ে এসেছেন পড়াতে। শেষ বাক্যটা ব্যাঙ্গ করেই বলল। ভূমিকার কথা শুনে হাত দিয়ে তার চাপ দাড়িতে স্লাইড করতে করতে সুফায় বসে পড়লো দিগন্ত । এবার সেও বেশ চিন্তিত। পরক্ষনেই একটা আইডিয়া মাথায় এলো দিগন্তের। হাসি মাখা মুখ করে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-ঝটপট প্যাকেট হয়ে যাও।
-মানে। ভ্রু কুচকিয়ে বলল ভূমিকা।
-মানে, বোরখা পরে প্যাকেট হয়ে নাও। তাহলে তো তোমাকে আর কেওই চিনতে পারবে না।
-কিন্তুু বোরখা পাবো কোথায়। আমার তো বোরখা নেই। ইনোসেন্ট মুখ করে বলল ভূমিকা। ভূমিকার কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় দিগন্ত। টি-শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে বলল,
-আজ তোমার কলেজে যেতে হবে না। আমি ফেরার সময় তোমার জন্যে বোরখা নিয়ে আসবো। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় দিগন্ত। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আবার পিছনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, দরজাটা লক করে রেখে। আমি ব্যতিত অন্য কেও আসলে দরজা খুলবা না। মনে থাকবে। ভূমিকা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে দিগন্তের কথার সম্মতি দেয়। অতঃপর দিগন্ত চলে যায়। দিগন্ত চলে যেতেই ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয় ভূমিকা।
ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে আড্ডাদিচ্ছে দিগন্ত। এমন সময় মিমি আসলো ওদের কাছে। মিমিকে দেখেই দিগন্ত মৃদু হাসলো। যার ফলে মিমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। নওশাদ দিগন্তের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-ভাই এটা ক্যাম্পাস। চোখে চোখে কথা বলা বন্ধকর। দিগন্ত নওশাদের পেটে ওর হাতের কুনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। মিমি এসে দিগন্তের পাশে পর হাত জড়িয়ে ধরে বসলো। তারপর আহ্লাদী সুরে বলল,
-তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছো দিগন্ত। তিন দিন ধরে আসছো অথচ একবারের জন্যেও আমার সাথে দেখা করো নি।
-সরি ডার্লিং। জানোই সামনে আমার এক্সাম পড়াশুনা নিয়ে ভিষন ব্যাস্ত। তাই চাইলেও এখন আগের মতো করে তোমাকে সময় দিতে পারছি না।
মিমি দিগন্তের কাঁদে মাথা রাখলো। তখন তপু হালকা কাঁশি দিলো। মিমি সাথে সাথে দিগন্তের কাঁদ থেকে তার মাথা সড়িয়ে নিলো। তখন মিমির চোখ পড়লো মাহিনের উপর। ছেলেটা মুখ গুমড়া করে চুপচাপ বসে আছে। মিমি উৎসাহ নিয়ে মাহিনকে জিগ্যেস করলো,
-মাহিন ভাই, আপনার কি মন খারাপ। প্রতিউত্তরে মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো মাহিন। না তার মন খারাপ নয়। দিগন্ত তপু আর নওশাদ শক্ত চোখে তাকালো মাহিনের দিকে।
বন্ধুূদের সাথে আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরবে তখনি মিমি দিগন্তকে বলে, সে মার্কেটে যাবে। আর তখনি দিগন্তের মনে পরে ভূমিকার কথা। ভূমিকা তো বাসায় একা আছে। তার আরো আগে বাসায় যাওয়া উচিৎ ছিলো। মিমি বায়না ধরে সে দিগন্তের সাথে যাবে। পরক্ষনেই মনে পড়ে ভূমিকাকে বলা কথা। উহঃ বোরখার কথা একদমই মনে ছিলো না। এখনি শপিংমলে যেতে হবে। মিমির সাথে গেলে সে কিছুতেই বোরখা কিনতে পারবে না। মিমি সন্দেহ করবে। দিগন্ত চায়না মিমি তাকে সন্দেহ করুক। তাই দিগন্ত সিদ্ধান্ত নিলো সে একাই যাবে শপিংমলে। কিন্তুু প্রবলেম হলো দিগন্ত ভূমিকার সাইজ যানে না। কি সাইজের বোরখা নিবে। আচ্ছা মিমিকে বলবে সাহায্য করতে। না থাক, মিমি নানা প্রশ্ন করবে। তাহলে কি ভূমিকাকে কল করে ওর সাইজ জেনে নিবে। হ্যাঁ এটাই বেটার অপশন। তারপর বন্ধুদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিমিকে কোন রকমের বুঝিয়ে সে একাই রওনা দেয় শপিংমলের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ভূমিকাকে কয়েকবার কল করে দিগন্ত। কিন্তুু ভূমিকা একবারও কল উঠায় না। বিরক্ত হয়ে দিগন্ত কল কেটে পকেটে পুরে রাখে মোবাইল। কি এমন রাজকার্য করছে। কল রিসিভ করার সময় পাচ্ছেন না মহারানী।
নিজের পছন্দমতো একটা বোরখা কিনে নিলো দিগন্ত। তারপর মনে হল এর সাথে হিজাব টাইপের কিছু লাগবে। দুটো হিজাব আর কতগুলা হিজাব পিন নিলো সাথে। তারপর রওনা দিলো বাসার উদ্দেশ্যে।
দুপুরের রান্না শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্যে মাত্রই সুফাতেই গা এলিয়ে দিয়েছে ভূমিকা। আর তখনি কলিংবেল বাঝতে শুরু করলো। একরাশ বিরক্ত নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দেয় ভূমিকা। দরজার ওপাশে দিগন্তের হাসি মাখা মুখ দেখে বিরক্তিটা আরো বেড়ে যায়। এই ছেলেটা সব সময়ই ভূমিকার কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। কখনো ঘুমে কখনো টিভি দেখায় আবার কখনো কাজে। ভূমিকাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দিগন্ত। সুফার উপর শপিং ব্যাগ রেখে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। আর ভূমিকা দরজা লক করে এসে সুফায় ব্যাগ দেখে একবার ভাবলো ভেতরে কি আছে সেটা দেখবে। পরে আবার মনে হলো। না থাক, পারসোনাল জিনিসও থাকতে পারে। পারমিশন ছাড়া কারো জিনিসে হাত দেওয়া ঠিক নয়।
দুপুরে খেতে বসে চুপচাপ খেয়ে নেয় দিগন্ত। ভূমিকাও আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলে না। ওদের দুজনের কথা বলা মানেই হলো একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করা। রাতে দিগন্ত পড়া শেষ করে তবেই খেয়েছে। তাই ভূমিকার সাথে দেখা হওয়ার কোন চাঞ্চই নেই।
পরের দিন সকালবেলা সমস্ত কাজ শেষ করে যখন কলেজে যাওয়ার জন্যে তৈরী হতে যায় ভূমিকা তখন মনে পড়ে দিগন্ত ওর জন্যে বোরখা আনবে বলেছিলো। কিন্তুু দিগন্ত সেটা আনেনি। তাহলে কি আজও কলেজে যাবে না সে। না, ওই লোকটার জন্যে ভূমিকা কেন কলেজে যাওয়া বন্ধকরে দিবে। আর দিগন্ত বোরখাই আনলো না কেন?? এর জবাব তো তাকে দিতেই হবে। রাগে কটমট করতে করতে দিগন্তের রুমে যায় ভূমিকা। দিগন্ত তখনো বইয়ের পাতায় মুখ গুজে ছিলো। ভূমিকা একবার ভাবলো সে এখন দিগন্তকে কিছু বলবে না। কিন্তুু ক্রোধ, তাকে বুঝাবে কি করে?? তাই সে দিগন্তের পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে ওর হাত থেকে বই নিয়ে সেটা অন্য জায়গায় রাখলো। ভূমিকার এমন কাজে বেশ রাগ হলো দিগন্তের। তাই সে ক্রোধান্বিত হয়ে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এই মেয়ে তোমার প্রবলেম কি হ্যাঁ।
-আপনার প্রবলেম কি সেটা বলুন। কাল তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলেন আমার জন্যে বোরখা নিয়ে আসবেন। তাহলে কই? আমার বোরখা কই? দেখুন আমি কিন্তুু আজ কলেজ মিছ করবো না বলে দিলাম।
-তোমার বোরখা তো,,, ওহ শিট, তোমাকে তো বলাই হয়নি। এই যে মেডাম ড্রয়িংরুমে সুফার উপর আপনার বোরখা রাখা আছে। এখন যান সেটা নিয়ে আমাকে ধন্য করুন। কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো দিগন্ত। তারপর ভূৃমিকার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায় ওয়াশরুমে। আর ভূমিকা ভেঙচি কেটে সেখান থেকে চলে আসে।
মনের আনন্দে গুনগুনিয়ে গান গায়তে গায়তে শপিং ব্যাগ নিয়ে নিজের রুমে যায় ভূমিকা। তারপর বেশ উৎসাহ নিয়ে বোরখাটা বের করে। ওয়াও কালারটা দারুন হইছে। দিগন্তের পছন্দ আছে বলতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোরখাটা নিজের শরীরে জড়াতেই ভূমিজার মেজাজ গেল বিগড়ে। বোরখার সাইজ দেখে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানায়। তারপর কাবার্ড থেকে নতুন থ্রি-পিছ পরে নিলো। অতঃপর বোরখাটা আবার প্যাকিং করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দিগন্তের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। এখন শুধু দিগন্তের আসার অপেক্ষা তারপর যে ওর কি অবস্থা হবে সেটাই ভাবছে ভূমিকা।
#বেলা_শেষে [০৬]
দাঁত দিয়ে হাতের নোখ কামড়াচ্ছে আর আকাশ পাতাল ভেবে যাচ্ছে ভূমিকা। দিগন্ত যখন ড্রয়িংরুমে আসবে তখন কি করবে, প্রথমে বোরখাটা ওর মুখের উপর ছুঁড়ে দিবে। না, এটা করা ঠিক হবে না। যতই হোক দিগন্ত সম্পর্কে ভূমিকার স্বামি হয়। তাহলে কি করবে ভূমিকা। রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে তার। শপিং ব্যাগ থেকে বোরখা বের করে সেটা আবার পরখকরে নিলো। তারপর মনে মনে ভাবলো, ওই খবিশটার গার্লফ্রেন্ড মনে হয় খাটো। তার মাপেই হয়তো কিনেছে এই বোরখাটা। কুমির কোথাকার। সারাক্ষণ মিমি বিবির সাথে থেকে থেকে চোখে পর্দা পরে গেছে। তাই যার জন্যে জিনিস কিনতে যায়না কেন, সব মিমির সাইজেই কিনবে। হাতের বোরখাট দলা পাকিয়ে নিচে ফেলে দিতে চেয়েও দিলো না। সুফার এক কোনে রেখে দিলো আর বিরবির করে বলল,
-এটা আপনার মিমিকেই দিয়েন। জলহস্তী কোথাকার। সামনে তাকাতেই ভূমিকার মুখ হা হয়ে গেলো। দিগন্ত আসছে। এ্যশ কালারের প্যান্টের উপর শুভ্র রাঙা শার্ট। মনে হচ্ছে এখনি শাওয়ার নিয়েছে। চোখমুখ স্নিগ্ধ লাগছে দিগন্তের । তার উপর ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি।ভূমিকার বুকের ভেতরে ধুকবুক করছে। মুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ভূমিকা। ভূমিকার এমন ধারা চাহনি দেখে দিগন্তের ওর সামনে তুরি বাজিয়ে বলল,
-এভাবে হা করে কি দেখছেন।
ভূমিকা যতটা সম্ভব নিজের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রনেয় রাখারা চেষ্টা করছে। কিন্তুু ওর অবাধ্য চোখ যেন বারবার বলছে, আর একটু দেখি। ভুল কি তাতে। ভূমিকা ওর দৃষ্টিকে বুঝাতে গিয়েও ব্যার্থ হয়। সেই অবাধ্য দৃষ্টি দিগন্তের চুলের দিকে। ভূমিকা পড়লো মহা ফাসাদে, এবার যেন তার হাতটাও অবাধ্য হতে চাইছে। সে বারবার করে চাইছে দিগন্তের মাথার চুল ছুইয়ে দিতে।
-ও হ্যালো, কোথায় হারালেন। ভূমিকার সামনে তুরি বাজিয়ে বলল দিগন্ত।
-হ্যাঁ-হ্যাঁ বলুন। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা।
-এত কি ভাবছো হ্যাঁ। তারপর ভূমিকাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
-তোমার বোরখা কোথায়?? এভাবে যাবে নাকি কলেজে?
-হ্যাঁ। মানে ওই বোরখা। না মানে আসলে, বোরখা।
-কি মানে মানে করছো বলোতো। বলেই পাশে তাকায় দিগন্ত। আর সুফার উপর দলা পাকানো বোরখা দেখতে পায়। দিগন্ত ভুমিকার দিকে ভ্রু কুচকিয়ে বিরবির করে বলে, বোরখা পছন্দ হয়নি ম্যাডামের। তারপর বোরখা হাতে নিয়ে সেটা মেলে দেখে। এদিকে ভূমিকা কিছু বলতে পারছেনা। কিছুক্ষণ আগেই মনেমনে দিগন্তের দফা রফা করছিলো আর এখন ভেজা বেড়ালের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। কিছু যে বলবে সেটাও পারছে না। সব কথা গলার মাঝে কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দিগন্তকে দেখে যাচ্ছে।
দিগন্ত মুখটা বাকা করে বোরকাটা আগের জায়গায় রেখে দিলো। তারপর ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি কিছু খেতে দিবে।
-হ্যাঁ দিচ্ছি। তারপর বড়বড় পা ফেলে রান্নাঘরে চলে যায়। দিগন্তর গিয়ে ড্রাইনিং এ বসে। একএক করে দিগন্তের সামনে সব খাবার সাজিয়ে দেয় ভূমিকা। দিগন্ত খাওয়া শুরু করে। আর ভূমিকা সেখানে বসে বসে তাকিয়ে থাকল দিগন্তের দিকে। খাওয়ার এক পর্যায়ে দিগন্ত বলে,
-একটু লবন দাও। ভূমিকা পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলে, লবন। দিগন্ত অবাক চোখে তাকায় ভূমিকার দিকে। কারনটা হলো এত বড় ভুল তাও আবার ভুমিকা। অসম্ভব। দিগন্ত ভাবলো হয়তো ভূমিকা ঠিকমতো শুনতে পায়নি।কিছুক্ষণ পরে আবারও বলল,
-ভাজির বাটিটা দাওতো। ভূমিকা একটা চামিচ এগিয়ে দিলো। দিগন্ত ভ্রু কুচকিয়ে ভূমিকার দিকে তাকালো। তখন খেয়াল করলো ভূমিকা কাঁপছে।
-আর ইউ ওকে ভূমি। দিগন্তের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে ভূমিকা শুধু মাথা নাড়ালো কোন কথা বলল না।
-ভূমি। তুমি এরকম উদ্ভট আচরন কেন করছো। তুমি ঠিক আছতো।
-আ- আমি আসছি। কথাটা কোন রকমে বলে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলো। ভূমির এমন আচরনে একটু বেশীই অবাক হলো দিগন্ত। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ভূমিকার চলে যাওয়ার দিকে।
ভূমিকা ওয়াশরুমে এসে মুখে পানির ছিটা নিলো। বুকের উপর হাত রেখে বড় বড় করে শ্বাস নিলো কয়েকবার। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একটু আগের ঘটনা মনে পড়তেই নিজেকে গালি দিতে লাগলো সে। ছিহ্ ভূমি, এটা তোর থেকে আশা করিনি। আচ্ছা বলতো, একটু আগে কি হয়েছিল তোর। এখন ওই লোকটা কি ভাবছে তোর সম্বন্ধে। বড় করে শ্বাস ফেলে দু-চোখ বন্ধকরে নিলো ভূমিকা। আর তখনি দিগন্তের সেই হাসিমাখা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে ভূমিকার। চট করে চোখ খুলে আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে শুকনো ডুক গিলে। বুকের ভেতর এখনো কেমন ধুকধুক শব্দ করছে।
এদিকে দিগন্তে খাওয়া শেষ করে বসে আছে। ভূমিকা আসলে ওকে নিয়ে একসাথে কলেজে যাবে। কিন্তুু ভূমিকার আসার কোন নামই নেই। হাতের ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে সে উঠে ভূমিকার রুমের দিকে রওনা দিলো। ভূমিকা তো রুমে নেই, তাহলে গেলো কোথায় মেয়েটা। আশ্চর্য। ওয়াশরুমে, কিন্তুু এত সময় ধরে ওয়াশরুমে কি করছে। দিগন্ত ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ওয়াশরুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই সে পানি পড়ার শব্দ পায়। তার মানে ভূমিকা ভেতরেই আছে। দিগন্ত হাত দিয়ে দরজায় বারি দিলো। তারপর বলল,
-ভূমি, আর ইউ ওকে??
দিগন্তের কথা কানে আসতেই চমকে উঠলো ভূমিকা। আয়নার দিকে তিক্ষ্ম দৃষ্টি রাখলো সে। তারপর বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো। এদিকে ভূমিকার জবাব না পেয়ে বেশ চিন্তিত দিগন্ত। আচ্ছা সে কি ওয়াশরুমের ভেতরে যাবে। যদি ভূমিকার কোন বিপদ হয়। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে সে ওয়াশরুমে ডুকে পরে। ওয়াশরুমে ডুকতেই দেখে ভূমিকা বড় বড় চোখ করে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
-এই স্টুপিড মেয়ে, তোমার কি কোন কান্ডঞ্জান নেই নাকি।
পিছনের দিকে ঘুরে তাকালো ভূমিকা। কিন্তুু দিগন্তের দিকে তাকালো না সে।
-কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নেই??
-হুম চলুন। বলেই ভূমিকা ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। আর দিগন্ত বিরবির করে বলল, স্টুপিড মেয়ে। তারপর সেও চলে আসলো সেখান থেকে।
রাস্তায় এসে দুজনে দুদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকা সে দিগন্তের সাথে কলেজে যাবে না। আর দিগন্ত সে ভূমিকাকে একা ছাড়বে না। কারন ভূমির কিছু হলে তার জবাবদিহি তো দিগন্তকেই করতে হবে। দিগন্ত কোন রকমের রিক্স নিতে চাচ্ছে না। এই কথাটা সে ভূমিকাকে বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ। ভূমিকার এক কথা সে নিজের প্রটেকশন নিজেই দিতে পারে। তার জন্যে কারো হেল্প তার প্রয়োজন নেই।কিছুক্ষণ পর একটা নিয়ে ভূমিকা ওর কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দিগন্ত সে বেচারা ভূমিকার দিকে কিছুক্ষণ ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে তার বাইক নিয়ে চলে যায়।
প্রথম দিন কলেজে এসেই দুজন বন্ধু পেয়েছে ভূৃমিকা।তাদের মধ্যে একজন ছেলে আর অপর জন মেয়ে। নিতু আর রাতুল। দুজনেই খুব মিশুক টাইপের। বন্ধুদের সাথে গল্পআড্ডায় বেশ জমে উঠেছে তার কলেজ। যেহেতু আজ তার প্রথম দিন কলেজের, তাই সে বেশী ক্লাস করতে ইচ্ছুক নয়। ভূমিকা চায় আজ পুরো কলেজটা ঘুরে ঘুরে দেখবে সে। তার বন্ধুরাও তার কথা সমর্থন করে। তারপর তারা তিনজনে মিলে কলেজের আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকে। কিন্ত এত বড় কলেজের অর্ধেকটাও দেখা হয়না তাদের। এদিকে ভূমিকার পায়ে ব্যথা করছে। তাই ভূমিকা সিদ্ধান্ত নিলো আজ আর নয়। পরে আরেকদিন দেখবে।
ক্যান্টিনে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছে দিগন্ত। আজ ওদের সাথে মিমিও আছে। মিমি দিগন্ত পাশাপাশি ই বসে আছে। মাহিন আজ নেই। কোন কারনে আজ সে কলেজে আসে নি। কথা বলার এক পর্যায়ে দিগন্তের চোখ পরে ক্যান্টিনের সামনে। আকাশি কালারের থ্রি-পিছ পরিহিতা এক প্রানউচ্ছল মেয়ের দিকে। যে হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলে তাদের দিকেই আসছে। দিগন্ত সেই রমনীর হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আনমনে বলে ফেললো, খিটখিটে মেয়েদের হাসি বুঝি একটু বেশীই কিউট হয়।
-কোন খিটখিটে মেয়ে? কার কথা বলছিস তুই দিগন্ত। নওশাদের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে ঘোর কাটে দিগন্তের। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
- নাহ কেও না?? মিমি ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো দিগন্তের দিকে। দিগন্ত আড় চোখে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে দেখতো ওরা ক্যান্টিনেই একটা টেবিলে বসেছে।
হঠাৎই তপু খেয়াল করলো ভূৃমিকাকে। ওদের থেকে চার টেবিল পরে ভূমিকা তার বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তপু ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূৃমিকার দিকে। কাজের লোক হলেও ওকে ঠিক কাজের লোকের মতো লাগে না। তপুর কেন জানি মনে হয় দিগন্তের ওদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। একটু বাজিয়ে দেখা যাক। মেয়েটার কথা চালচলন খুব ইউনিক। আজকালের মেয়েদের মাঝে এটা খুব কমই লক্ষ করা যায়। তপু ভূমির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দিগন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-এটা ভূমিকা না, যে তোর বাসায় কাজ করে???
তপুর কথা শুনে দিগন্ত ভূমিকার দিকে তাকালো। সে এখনো বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। কিন্ত দিগন্ত এখন কাজের লোক কথাটা হজম করতে পারলো। সেদিন ভেবেছিল ঘটনাটা সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। কলেজে এসেও ওকে কাজের লোক তকমাটা পেতে হবে এটা ভাবেনি দিগন্ত। তপু উঠে দাঁড়ায়। ওর সাথে সাথে দিগন্ত মিমি নওশাদ সবাই উঠে দাঁড়ায়। আর ভূমিকাদের টেবিলের সামনে যায়।
দিগন্তের বন্ধুদের টেবিলের চারিপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় ভূমিকা। তখনি তপু প্রশ্ম করে,
-কাজের লোক হয়ে এত বড় কলেজে পড়তে এসেছো।
-তাতে আপনার কোন সমস্যা আছে?? [ভূমিকা]
-তা নেই। তবে এত বড় একটা কলেজে কাজের মেয়ে পড়বে ব্যপারটা কেমন দেখায় না। [তপু]
-আচ্ছা। কলেজের কোথাও কি লেখা আছে এখানে কাজের লোক কিংবা তাদের ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা করতে পারবে না। শুনুন, এটা কলেজ,এখানে পড়াশুনা করা হয়। তাই কেন বড়লোক আর কে গরীব সেটা দেখার কারো টাইম নাই। এখানে সবাই তাদের যোগ্যতায় আসে। আপনাদের মতো লোকেরা টাকার জোরে আসলেও আমরা আসছি মেধার জোরে। ভূমিকার কথা শুনে দিগন্তের অধরে হাসি ফুটে উঠলো। ওষ্ঠদ্বয় চেপে হাসলো সে।
#বেলা_শেষে। [০৭]
ভূমিকার এমন কঠিন জবাব আশা করেনি তপু। তার কথার প্রতিউত্তর এভাবে দিবে ভূমিকা সেটা কল্পনাতেও ভাবে নি সে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ক্যবলাকান্তের ন্যায় মুখ করে তাকিয়ে আছে ভূমিকার দিকে। ভূমিকা এখন নরমালি ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। দিগন্ত অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভূমিকার দিকে। ভূমিকা এমন কিছু বলবে সেটা দিগন্তের ও ভাবনার বাইরে ছিলো। দিগন্ত ভেবেছিল ভূমিকা হয়তো সত্যিটা সবাইকে বলে দিবে। আবারও ওকে ভুল প্রমানিত করলো ভূমিকা।
ভূমিকা ওর বন্ধুদের নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়ে যায়। দিগন্ত মিমি নওশাদ আর তপু ওদের আগের জায়গায় গিয়ে বসে। নওশাদ তপুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-আরে মামা এত চুপ হয়ে গেলে যে। মেয়েটার জবাব হজম হয়নি বুঝি। নওশাদের কথা শুনে মৃদু হাসলো দিগন্ত। মনে মনে বলল, ধানি লঙ্কার ঝাঁজ কি সবাই সহ্য করতে পারে। তবে যাই বলি, ভূমি আজ মুখ্য জবাব দিয়েছে। সবাই যদি মানুষের প্রফেশন দেখে জার্জ করে তাহলে গরীব মাধ্যবিত্তদের অবস্থা কি হবে। আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছে যারা গরীবদের মানুষ বলে মনে করে না। অর্থের অহংকারে মানুষ এটা ভুলে যায় দেশে গরীর চাষি, জেলে কামার কুমার তাঁতি কাজের লোক আছে বলেই তাদের মতো ধনীরা আজও সৌখিন ভাবে বেঁচে আছে। আচ্ছা সব জায়গায় কি অর্থদিয়ে দিয়ে বিচার করলে হয়। না হয়না। গরীবদের কি বড় বড় ইউনিভার্সিটি পড়তে নেই।সব মেধাবীরাই কি বড় লোক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। করে না তো। তাহলে সমাজে ধনী দারিদ্রের এত বৈষম্য কেন?? আজ ভূমিকা কাজের মেয়ে হয়ে কলেজে এসেছে বলে দিগন্তের বন্ধুরা ওকে অদ্ভুত চোখে দেখছে। কাজের মেয়েরা কি লেখাপড়া করতে পারবে না নাকি। এটা নিয়ে কি সংবিধানের কিছু লেখা আছে।
ভূমিকার চলে যাওয়ার দিকে এখনো মুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যান্টিনে বসে থাকা এক সুদর্শন যুবক। লম্বা মুখ আকৃতির এই সুদর্শন যুকটি এতক্ষণ ভূমিকার কথা গুলো শুনছিলো আর ভূমিকাকে দেখছিল। প্রথম দেখাতেই এক অন্যরকম অনুভূতির জন্মহয় তার মনে। আনমনেই বুকের বা পাশটাতে হাত রাখে সে। তারপর মৃদু হাসে। হাতের সাহায্য বুকের ধুকবুকানির শব্দ অনুভব করে সে। ওষ্ঠদ্বয় চেঁপে স্মিত হাসে।
রাস্তার এক পাশে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছে ভূমিকা। ভূমিকার বন্ধুরা ওকে একা ছেড়ে চলে গেছে। আসলে ভূমিকাই ওদের যেতে বাধ্য করেছে। ভূমিকার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বাইকের উপর দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত। ভূমিকা এখন কি করে সেটাই দেখছে। দিগন্তের বাইক এ তো সে যাবে না। এদিকে প্রায় দশ মিনিট ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভূমিকা। না কোন রিক্সা আসছে আর না কোন অটো আসছে। ইচ্ছে করছে হেটে যেতে। কিন্তু এখন সেটাও হবে না। এখান থেকে ওদের বাসা অনেকটা দূরে। ভূৃমিকার পক্ষ এখন এত রাস্তা হেটে যাওয়া সম্ভব নয়। বিরক্তি নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভূমিকা। দূর থেকে এই বিরক্তি মাখা মুখ দেখে মুখ টিপে হাসছে দিগন্ত। আর মনে মনে রিক্সাওয়ালাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে সে। এই ভাবেই যদি এই ধানি লঙ্কার ঝাঁজটা একটু কমানো যায়।
কিছুক্ষণ পর একটা লোকাল বাস আসলো আর ভূমিকা সেটাতেই উঠলো। দিগন্ত কেন জানি ভূমিকার বাসে উঠাটা ঠিক মেনে নিতে পারলো না। আজকাল লোকাল বাসে উঠাটা কেও ভালোভাবে মেনে নিতে পারে না। এই বাসেও এখন দিনে দুপুরে ক্রাইম হয়। দিগন্তের মনে পরে যায় কিছুদিন আগের ঘটনা। বন্ধুদের সাথে ক্লাবে গিয়েছিল সেদিন। ড্রিঙ্ক করে বাসায় ফেরার সময় পথিমধ্যে একটা মেয়েকে দেখতে পায় । ড্রাংক অবস্থায় থাকলেও হুস একেবারেও হায়ারনি কেও। মেয়েটার শরীরের অর্ধেক জামাকাপড় ছিলোই না বলে চলে। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছিলো। আর মেয়েটা ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। দিগন্তের ও তার বন্ধুরা মেয়েটাকে নিয়ে হসপিটালে যায়। হাসপিটালের লোকেরা মেয়েটাকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার পর ওদের কে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ডক্টরদের ধারনা ওরাই কিছু একটা করেছে। দু-দিন পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল দিগন্তরা। কারন মেয়েটা নিজে এসে পুলিশের কাছে জবাববন্দি দিয়েছিলো। সেদিন মেয়েটা তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলো। শহর ছেড়ে পালানোর জন্যে একটা বাসে উঠে তারা। সেই বাসে কয়েকজন ছেলেছিলো শুধু। তবুও তারা সেই বাসটাতেই উঠছিলো। কারন তাদের পালাতে হবে। কিন্তু ভাগ্য সেদিন তাদের সহায় ছিলো না। চলতি বাসে সবাই মিলে মেয়েটাকে গন ধর্ষণ করে। আর ছেলেটাকে বাস থেকে ধাক্কাদিয়ে ফেলে দেয়। সেদিনের কথা মনে পড়তেই বুকটা ধুক করে উঠে দিগন্তের। সে বাসের কাছে এগিয়ে যাবে এমনি সময় নওশাদ ওকে ডাকদিয়ে বলে,
-প্রিন্সিপ্যাল স্যার তোকে ডাকছে। দিগন্ত নওশাদের দিকে একপলক তাকালো। তারপর আবার সেই বাসের দিকে তাকালো। তখন দেখতে পেল একটা সুদর্শন যুবক সেই বাসে উঠছে। দিগন্ত ভ্রু কুচকিয়ে সে দিকে তাকালো। এই ছেলেটা বাসে উঠছে কেন?? যে প্রতি মাসে একটা করে গাড়ি চেঞ্জ করে সে কিনা লোকাল বাসে উঠছে। অদ্ভুত না বিষয়টা।
-কি রে!! এত কি ভাবছিস। স্যার তোকে ডাকছে।
-হ্যাঁ চল যাচ্ছি। দিগন্তের অনিচ্ছা থাকা সত্তেও সে নওশাদের সাথে যায়।
বেশ অস্বস্তি নিয়ে গাড়িতে বসেআছে ভূৃমিকা। কারন ওর পাশেই বসে আছে একটা বুড়া লোক। বয়সটা বেশী হলেও তাকে কাবু করতে পারেনি মনে হচ্ছে। কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে ভূমিকার দিকে। মনে মনে লোকটার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে ভূমিকা। শালা লুচু, খবিশ মেয়ে দেখিসনি কখনো। এক পা কবরে আছে তারপরেও লুচুগিরি। ভূমিকার একবার ভাবলো সে উঠে চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু এখানে তো কোন সিট খালি নেই তাহলে সে কোথায় বসবে। এদিকে লোকটা ধীরে ধীরে ভূমিকাকে ঘেসে বসছে।
-এই যে টাকলা দাদু একটু ওদিয়ে সরে বসুন। এমনভাবে চেপে বসছেন আমি তো গাড়ি থেকে পড়ে যাব। টাকলা দাদু ডাক শুনেই লোকটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। তারপর দুজনের সাথে বেশ কথাকাটিও হয়। এক পর্যায়ে লোকটা ভূমিকাকে বেয়াদব মেয়ে বলে সম্বোধন করলো। তাতেও ভূমিকার কিছু যায় আসেনা। কারন এই তকমা সে আগেই অনেকবার পেয়েছে। তখন একটা যুবক এসে ভূমিকাকে সাহায্য করলো। আর গাড়িতে সকলের সামনে সেই বুড়ো লোকটাকে অপমান করো। এদের মতো লোকেদের কারনে আমাদের সমাজের মেয়েরা এতটা অনিরাপদ। অপমানিত হয়ে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে যায়। তারপর ভালোভাবেই বাকিটা রাস্তা পাড়ি দেয় ভূমিকা। আজকাল বৃদ্ধা লোকেদের থেকে যুবকদের কাছে মেয়েরা সেইভ বেশী। বুড়োরা মেয়েদের সুযোগ নেয়। আর সেখানে অনেক যুবকরা সেই সুযোগকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করে। আমাদের যুব সমাজের দায়িত্ব অনেক বেশী।
বিছানায় বই নিয়ে বসে মাত্রই বইয়ের পাতা উল্টিয়েছে ভূমি। এমন সময় মাশহুদ তালুকদার কল করলো। মোবাইলের স্কিলে আব্বাজান নামটা দেখেই শুকনো ডুক গিলল ভূমিকা। ইনোসেন্ট ফেসকরে মোবাইলের স্কিনের উপর তাকিয়ে আছে ভূমিকা। কল বাজতে বাজতে মোবাইলটা কেটে গেলো। এবার মনে হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো ভূমি। বড় করে শ্বাস নিলো। কিন্তু তার এই স্বস্তি বেশীক্ষণ টিকলো না। মাশহুদ তালুকদার আবারও কল করলেন। ভূমিকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দৌড়ে দিগন্তের রুমে চলে আসলো। দিগন্ত ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে শার্টের বাটন লাগাচ্ছিল এমন সময় ভূমিকাকে দৌড়ে আসতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় সে। ভূমিকার দৌড়ের স্প্রিড এতই ছিলো যে সে ব্রেক করার সময় টাল সামলাতে না পেরে দিগন্তের উপর ঝাপিয়ে পরে। আর দিগন্ত ভূমিকার স্প্রিড সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়।
নিচে পরে আছে দিগন্ত। আর দিগন্তের উপরে শুয়ে আছে ভূমিকা। ভূমিকার তার হাত দিয়ে দিগন্তের শার্ট খামচে ধরে আছে। আর দিগন্ত তার হাত রেখেছে ভূমিকার বাহুর উপর। দুজনেই কিছুটা সময় দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-তুমি ঠিক আছো?? দিগন্তের করা প্রশ্নের কোন রকমের উত্তর দেয় ভূমিকা।
-হ্যাঁ - হ্যাঁ।
-তাহলে উঠ। এভাবে পরে না থেকে উঠে দাঁড়াও।
ও হ্যাঁ হ্যা। বলেই ভূমিকা দিগন্তকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দিগন্ত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ওই মেয়ে খাও কি তুমি। এত ভারি কেন?? দিগন্তের কথায় মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর সে বলল, আসলে আমার ভার আপনি নিতে পারবেন না। তারপর বিরবির করে বলল,
-ঠিকই বলেছেন আপনি। আমি একটু বেশীই ভারি কিনা। তাইতো বয়তে পারছেন না। ঝুলে আছি।
-কিছু বললে?? মাথাটা ভূমিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল দিগন্ত।
-নাহহ।
-ওওহ আচ্ছা। দৌড়াচ্ছিলে কেন ওভাবে?? কলের কথা মনে পড়তেই শুকনো ডুগ গিলল ভূমিকা। তারপর তুতলিয়ে বলল,
-আ-আব্বা কল করছে।
-ওও আচ্ছা। মানে কি বলল আব্বা।
-আমি কল রিসিভ করিনি মনে হয় কেটে গেছে। আপনি কথা বলুন না।
-আমি কেন?? তোমাকে কল করেছে তুমি কথা বল।
-আপনি বললে প্রবলেম কি?? আপনি কথা বলুন আমি আসছি। বলেই চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় ভূমিকা। আর তখন দিগন্ত ভূমিকার হাত ধরে ফেলে। ভূমিকা হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে দিগন্তের মুখের দিকে তাকায়। তখন দিগন্ত বলে,
-আমি কল করছি। তুমি একটু এখানে থাকো। আব্বা তোমাকে চাইতে পারে। ভূমিকা হাতের দিকে দৃষ্টিরেখে মাথা নাড়ায়। অতঃপর দিগন্ত মাশহুদের নাম্বারে কল করে।
দুজনেই মন খারাপ করে দু-দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকা হাতের নোখ কামড়াতে কামড়াতে এমন অবস্থা করেছে যে। আর একটু হলেই নোখ খেয়ে ফেলবে। আর দিগন্ত পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে।
#বেলা_শেষে। [বোনাস পার্ট]
কোন আইডিয়া পেলেন?? ভূমিকার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের প্রতিউত্তরে শুধু মাথা নাড়ালো দিগন্ত। ভূমিকা চোখমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
-কাজের সময় তো আপনার মাথায় কোন আইডিয়া আসেই না। এমন মাথা না রেখে কেটে ফেলে দিলেই পারেন। যত্তসব। উহঃ দেখুন আমি কিন্তু আপনার সাথে এক রুমে থাকতে পারবো না বলে দিলাম।
-এত বাজে বকো কিভাবে। তুমি টায়ার্ড হও না। বিরক্তি মুখ করে বলল দিগন্ত।
-আপনার মতো একটা মানুষ নামক জলহস্তীর সাথে থাকলে যে কেওই বাজে বকবে। ইনোসেন্ট মুখ করে বলল ভূমিকা।
-স্টুপিড মেয়ে একটা। একটা বললে হাজারটা শুনায়। এই মেয়েটা এত কথা কিভাবে বলে। আমি জাস্ট ভাবতে পারিনা। অতঃপর দিগন্ত রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। আর ভূমিকা সেখানেই দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে।
কিছুক্ষণ আগে যখন দিগন্ত মাশহুদকে কল করে তখন মাশহুদ জানায় সে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় আসছে। দিগন্তের মায়ের কোমড় ব্যথাটা বেড়েছে তাই তাকে ডাক্তার দেখানোর জন্যে ঢাকায় আসবেন তিনি। যেহেতু দিগন্ত আর ভূমিকা একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে তাই তারা সোজা দিগন্তের বাসাতেই আসবেন। তাছাড়া ছেলেমেয়ে দুটোর সাথে কয়েকদিন থাকবেন তিনি। মাশহুদ তার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে আসবেন বলে সবচেয়ে বেশী প্রবলেম হচ্ছে দিগন্ত আর ভূমিকার। সে এসে যদি দেখে দিগন্ত আর ভূমিকা দুজনেই আলাদা রুমে থাকে তাহলে ব্যপারটা অন্যরকম হবে। দিগন্ত এখনি তার বাবাকে কিছুই জানাতে চায়না। এক্সাম শেষে একেবারে বিয়ে করে তার বাবাকে জানাবে। ভূমিকা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সে দিগন্তের সাথে একই রুমে থাকবে না। আর দিগন্ত সেও চায়না ভূমিকা তার সাথে একই রুমে থাকুক। এখন কে কোথায় থাকবে এটা নিয়েই ভাবছিলো দুজনে।
শেষে কোন উপায় না পেয়ে ভূমি নিজের সমস্ত জিনিসপত্র দিগন্তের রুমে নিয়ে আসে। ভূমিকা বিষণ্ণ মন নিয়ে কাজ করছে। আর দিগন্ত বিছানায় বসে ভূমিকার এমন মুখ দেখে মুখ টিপে হাসছে। দিগন্ত উঠে গেল রান্নাঘরের দিকে। মেয়েটা আজ অনেক কাজ করছে এক কাপ চা করে খাওয়াতেই পারি। তারপর দিগন্ত নিজের আর ভূমিকার জন্যে দুকাপ চা করে নিলো।
কাবার্ডে নিজের জামাকাপড় ঘুছিয়ে রাখছিলো ভূমিকা, এমন সময় দিগন্ত এসে ওর সামনে এক কাপ চা ধরলো। ভূমিকা চায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে দিগন্তের দিকে তাকালো। দিগন্ত ইনোসেন্ট ফেস করে হাসি দিয়ে বলল,
-তুমি ব্যাস্ত তাই নিজেই চা করে নিলাম। খেয়ে দেখতে পারো। চা টা আমি ভালোই বানাই। স্মিত হাসলো ভূমিকা। তারপর দিগন্তের হাত থেকে কাপ নিয়ে তাতে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ঠেকালো। চায়ের স্বাদ অনুভব করতেই দু-চোখ বন্ধকরে নিল ভূমিকা আজকের চায়ের স্বাদটা অন্যরকম। বেশ ভালো লাগছে খেতে। তৃপ্তি সহকারে পুরো চা টা খেয়ে নিলো ভূমিকা।
রাতের আটটা নাগাদ মাশহুদ তার স্ত্রীকে নিয়ে পৌঁছে দিগন্তদের বাসায়। ভূমিকাকে পেয়ে যে মাশহুদ ও তার স্ত্রী হাতে চাদ পেয়েছে। আসার পর থেকেই সেই তিনজনে মিলে গল্প শুরু করে দিয়েছে। দিগন্ত ভেবে পায়না। এই কয়দিনে এত কথা জমা হয়ে আছে। কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে। সুফায় গুটিশুটি মেরে বসে সবার কথা শুনছে আর বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। কেও একবারের জন্যেও দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে না। আসলে এখানে যে দিগন্ত নামের কেও একজন থাকে এটা হয়তো তারা ভুলে গিয়েছে। এখানে নিজেকে ফোর্ট পারসোন সিঙ্গুলার নাম্বার মনে করছে দিগন্ত।
সবাই মিলে একসাথে এক টেবিলে বসে ডিনার করলো আজ। আজ মাশহুদের মনে হলো তার একটা পরিবার আছে। তবে কিসের যেন অপূর্ণতা লাগছে। তার মনে হচ্ছে তার পরিবারে এমন কিছু নেই। যেটা থাকার খুব প্রয়োজন।তবুও ছেলে বৌমাকে নিয়ে একসাথে আছেন এতেই অনেক খুশি মাশহুদ।
আজ রাতে দুজনের মাঝে তার তেমন কোন কথা হয়নি। ডিনার শেষ করে দিগন্ত বসেছিল পড়ার টেবিলে। এই সুযোগে ভূমিকা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। পড়া শেষ করে দিগন্ত যখন দেখতে পেলো ভূমিকা তার বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তখন দিগন্ত তার বালিশ আর চাদর নিয়ে গিয়ে সুফায় শুয়ে পরে
কলেজের মাঠে পা রাখতে মেজাজটা বিগড়ে গেলো ভূমিকার। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে এক সাথে দাঁড়িয়ে আছে আর তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে রয়েছে। যারা ওই ছেলেমেয়েদের দিয়ে কিছু না কিছু করিয়ে নিচ্ছে। ভূমিকার বুঝতে বাকি রইলো না এখানে র্্যগিং হচ্ছে। আজ ফ্রেশ মুড তাই কারো সাথে ঝামেলা করতে চায়না ভূমিকা। তাই ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো ভূমিকা এমন সময় একটা যুবক ভূমিকাকে ডাকদিয়ে বলল,
-এই যে মিছ তোতাপাখি, এদিকে আসেন??
ভূমিকা আশেপাশে তাকিয়ে তোতাপাখি খুঁজতে লাগলো বাট সে এখানে কোন তোতাপাখি দেখতে পেলো না। তখন সেই যুবকটি আবার বলল,
-আপনাকেই বলছি মিছ তোতাপাখি, এদিক ওদিক না দেখে এখানে আসুন।
-আমাকে বলছেন। একটু জোরেই বলল ভূমিকা। যুবকটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। অতঃপর ভূমিকা ওদের কাছে গেলো। ভূমিকা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই সেই যুবকটা বলল,
-তোতাপাখি কি নতুন এই কলেজে??
-আপনি আমাকে বারবার তোতাপাখি বলে সম্বোধন কেন করছেন?? আমি কি তোতাপাখি নাকি??
-সবুজ ড্রেসে তোমাকে একদম তোতাপাখির মতোই লাগছে গো। পাশ থেকে আরেকটা ছেলে বলল।
-একদম খাটি কথা বলছিস দোস্ত। [যুবকটি]
-আচ্ছা। মৃদু হেসে বলল ভূমিকা। সবুজ ড্রেসে আমাকে তোতাপাখির মতো দেখতে লাগছে তাইতো। রাইট। আপনি যে কালো ড্রেস পড়েছেন আমি কি একবারও বলছি আপনাকে কাকের মতো দেখতে লাগছে। ভূমিকার কথা শুনে সবাই তাজ্জব হয়ে গেলো। এই মেয়ে বলে কি??
-এই বেয়াদব মেয়ে এসব কি বলছো কি হুম।
-ভুল কি বললাম। সবুজ ড্রেস পড়লে যদি তোতাপাখির মতো লাগে তাহলে কালো ড্রেসে কাকের মতো লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক তাইনা। বলেই দু ঠোট প্রসারিত করে হাসি দিলো ভূমিকা। ছেলেগুলো ভূমিকার কথা শুনে বেকুব হয়ে গেলো। এভাবে নিজেদের কথায় নিজেরা ফাঁসবে সেটা ভাবতে পারেনি বোধহয়। অন্যএকটা ছেলে এসে ভূমিকার সামনে দাঁড়ায়। তার চোখে ক্রোধ স্পষ্ট। তবুও ভূমিকা হেলদুল নেই সে আগের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আর ঠোট চেপে হাসছে। তখনি ওদের পাশে একটা কালো বাইক এসে থামলো। বাইকটা দেখেই সকলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। ভূমিকা ভ্রু কুচকিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। কে এই বাইকার যাকে দেখে সকলে এভাবে পালিয়ে গেলো। ভূমিকার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাইকার তার হেলমেড খুলে সেটা বাইকের উপর রেখে ধীর পায়ে ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই ভূমিকা যেন পাঁচশো পাঞ্চাচ ভল্টিজের শক খেলে। এই লোকটাকে দেখে এভাবে ভয় পাওয়ার কি আছে। ভূমিকা এবার লোকটার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার কলেজের দিকে তাকাচ্ছে। তখন খেয়াল করলো কিছু কিছু মেয়েরা হা করে এই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। আর বাকিরা ভয়ে লেজ গুটিয়ে রেখেছে।
-হ্যালো মিছ।
ছেলেটার কথায় সামনে তাকায় ভূমিকা। অতঃপর বলে,
-আপনি আসাতেই সকলে এমন চুপচাপ হয়েগেল কেন।
লোকটা তার চাপ দাড়িতে হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে বলল,
-আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? ক্লাস নেই?
-মাত্রই আসলাম। আর তারপরেই কিছু ছেলের সাথে ঝামেলা। আপনাকে কেন এসব বলছি আমি। আমি ক্লাসে যাচ্ছি। ক্লাসে যাওয়ার জন্যে সামনের দিকে পা বাড়ায় ভূমিকা। আর তখনি লোকটা ভূমিকাকে প্রশ্ন করে,
-ছেলেগুলো কে ছিলো??
-জানিনা ।
-দেখলে চিনতে পারবেন??
-হ্যাঁ বাট। বাট আপনি কি আজকেও আমাকে হেল্প করবে নাকি। কাল আপনি না থাকলে কি যে হতো। আমি ওই বুড়ো লেকটাকে ধাক্কাদিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দিতাম। নিহাত আপনি এসেছিলেন না হলে কাল আমার হাতে একটা খুন হয়ে যেতো। ভূমিকার কথা শুনে স্মিত হাসলো লোকটা। অতঃপর মনে মনে বলল,
-আমি থাকতে আপনাকে এমন অন্যায় করতে দিবো নাকি।
-এইযে মিস্টার আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আমি ভূমিকা। আমাইরা ভূমিকা।
-আমি জুহায়িন আরাভ। বলেই ভূমিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডসেক করার জন্যে। জুহায়িন আরাভ নামটা শুনেই শুকনো ডুক গিলল ভূমিকা। আর তুতলিয়ে বলল,
-ভি.পি. আরাভ আপনি? আরাভ মৃদু হাসলে। আবারও ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা। তারপর বলল,
-সবার মুখে যে ভাবে আপনার কথা শুনছিলাম তাতে মনে হলো আপনার চোখ দুটো বেশী আছে। কান একটা বেশী, হাত হবে ছয়টা আর মাথায় হবে বড় বড় শিং। কিন্তুু আমি তো দেখছি আপনি আমাদের মতোই স্বাভাকিক মানুষ তাহলে আপনাকে সবাই ভয় কেন পায়। আচ্ছা আপনি কি কোন অলৌকিক ক্ষমতা জানেন। ভূমিকার কথায় না হেসে পারলো না আরাভ। হাসতে হাসতে বলল,
-না সে রকম কিছু না।
-তাহলে সবাই আপনাকে ভয় পায় কেন??
-আপনার ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে আরাভ। ভূমিকা ভেঙচি কেটে ওর ক্লাসে চলে যায়। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে বাইকে জোরে লাথি দিলো মাহিন। ভূমিকার সাথে আরাভ এর কি সম্পর্ক। যে আরাভ সব সময় মেয়ে মানুষ এড়িয়ে চলে। মেয়ে দেখলে যার শরীর এালার্জির মতো চুলকায় সেই কিনা কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে ভূমির সাথে কথা বলছে। না তার আর দেরী করলে চলবে না। আরাভ কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে তার কাজটা শেষ করতে হবে। না হলে
#বেলা_শেষে। [০৮]
হলরুমে বসে মোবাইলে স্কলিং করছিলো আরাভ এমন সময় দিগন্ত আর নওশাদ আসলো ওর কাছে। দিগন্তকে দেখে আরাভ তার মোবাইল রেখে মৃদু হেসে বলল,
-আরে দিগন্ত এসো। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডসেক করার জন্যে। দিগন্ত আরাভের সাথে হ্যান্ডসেক করে নিলো। তারপর বলল,
-আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন। আমাকে বললেই তো আমি আপনার সাথে দেখা করে নিতাম। দিগন্তের কথার প্রতিউত্তরে মৃদু হাসলো আরাভ। হয়তো তার এই হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে কিছু অনুভূতি। যেগুলো সে ছাড়া আর কেওই অনুভব করতে পারছে না। এই অনুভূতি গুলো নিয়েই #বেলা_শেষে একটা সুখের ঘর সাজানোর স্বপ্ন দেখবে।
-আমাকে কি জন্যে ডেকেছেন ভাই?[ দিগন্ত ]
আরাভ দিগন্ত হাতে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। দিগন্ত সেই কাগজগুলো সব উল্টিয়ে দেখে নিলো এটা তো সাদা কাগজ। আরাভ তাকে সাদা কাগজ কেন দিলো সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারছেনা দিগন্ত। দিগন্ত উৎসুক দৃষ্টিতে আরাভের দিকে তাকালো। তখন আরাভ বলে উঠলো,
-সাধারণত আমাদের কলেজে নবীন বরণ হয় না। বাট ইট উইল বি দিস ইয়ার। দিগন্ত তুমি সব ইয়ারের স্টুডেন্টদের একটা লিষ্ট করে নাও কে কি পারফরমেন্স করবে। আর হ্যাঁ এবার কিন্তুু তোমাকেই পারফরমেন্স করতে হবে।
-আমি। একটু অবাক হয়ে বলল দিগন্ত।
-ইয়েস। তুমি করবে পারফরমেন্স।
-কিন্তুু,,,,,
-কোন বাহানা শুনবো না আমি ওকে। আমাকে যেতে একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। আরাভ সানগ্লাস চোখে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে কয়েকটা পা সামনে এগিয়ে আসলো। তারপর কিছু মনে পড়তেই আবার পিছনের দিকে তাকায় সে। পিছনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় দিগন্ত আর নওশাদ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আরাভ মৃদু সুরে দিগন্তকে ডাক দিলো। দিগন্ত আর নওশাদ দুজনেই আরাভের দিকে তাকায়। আর তখন আরাভ বলে,
-কলেজে র্্যগিং হয়, কোথায় থাকো তোমরা।
-কিন্তু আমাদের কলেজে তো আগে থেকেই র্্যগিং হয়। নওশাদের কথায় হালকা মাথা নাড়ালো আরাভ তারপর বলল,
-র্্যগিং এর নামে কাওকে অসম্মান করা যেন না হয়। এখন তো তোমরাই সিনিয়র সবদিকে খেয়াল রাখবে ওকে।
-জ্বি জ্বি ভাই মনে থাকবে। অতঃপর আরাভ চলে যায়। দিগন্ত তার কয়েকজন সহপাঠী নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে সবাইকে বলে আসে ছূটির পর হলরুমে উপস্থিত থাকার জন্যে। যে যে পারফরমেন্স করবে তারা সকলে এসে হলরুমেই তাদের নাম লেখাবে। এদিকে দিগন্ত যখন ভূমিকার ক্লাসে আসে আর সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলে ভূমিকা গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই হাসির দিকে। দিগন্তের হাসির মুগ্ধতায় বরাবরই হাড়িয়ে যায় ভূমিকা। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
ভূমিকা গালে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। দিগন্ত কথা বলার ফাঁকে যখন লক্ষ করলে ভূমিকা তার দিকে তাকিয়ে আছে তখন দিগন্ত এগিয়ে আসলো ভূমিকার দিকে। ভূমিকার সামনে এসে সে মাথা হালকা ঝুকে ভূমিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-ছেলে দেখলে এভাবেই তাকিয়ে থাকো তাইনা?? লজ্জায় ভূমিকা চোখ মিটমিট করে অন্যদিকে তাকালো, একি ক্লাসে তো কেওই নেই। সবাই কোথায় গেলো?? ভূমিকা এদিক ওদিক তাকিয়ে তার সকল সহপাঠীদের খুজছে বাট কোথাও তাদের দেখা পেল না। তখনি অনুভব তার কোমড় কারো শীতল হাতের স্পর্শ। পাশে ঘুরে তাকাতেই দেখল দিগন্ত ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে। তারমানে দিগন্ত,দিগন্ত তার শীতল হাতে ভূমিকার কোমল পেটে স্লাইড করছে। ভূমিকা নিজেকে দিগন্তের থেকে ছাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। দিগন্ত আরো শক্তকরে ভূমিকার কোমড় চেপে ধরে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। এদিকে ভূমিকা লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হলুদ হয়ে যাচ্ছে। সে কোন রকমে বলল, দিগন্ত কি করছেন ছাড়ুন। ভূমিকার কথায় দিগন্তের কোন হেলদুল হলো না সে আগের ভঙ্গিতেই ভূমিকার কোমল পেটে স্লাইড করতে করতে ভূমিকার কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিলো। তারপর সেখানে তার ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়ালো। ভূমিকার তার দু-চোখ বন্ধকরে দিগন্তের ভালোবাসার পরশ অনুভাব করছে এমনি সময় কেও তাকে ধাক্কা দিলো। নিচে পরে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয় ভূমিকা।ঘোর কাটে তার। সামনে তাকাতেই দেখে সবাই তার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দিগন্ত তার আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে সকলের সাথে কথা বলছে। আনমনে কপালে হাত রাখলো ভূমিকা। তারমানে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিলো। আচ্ছা এই স্বপ্নটা কি সত্যি হতে পারে না। নিমিশেই তার মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। সে কেন এমন স্বপ্ন দেখলো। সত্যিই তো দিগন্ত তো তাকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নেয়নি আর নিবেও না। তাহলে ভূমিকার অবাধ্য মন কেন বারবার দিগন্তের মাঝে হাড়িয়ে যাচ্ছে। মন কে বুঝাতে হবে। ভূমি তুই তো স্ট্রোং মেয়ে তাইনা। তুই যদি এমনটা করিস তাহলে মানায় না। নিজেকে কন্ট্রোল কর ভূমি।
হলরুমের এক কর্নারে বসে আছে ভূমিকা নিতু রাতুল। আর ওদিকে দিগন্ত নওশাদ তপু আর ওদের আরো কয়েকজন বন্ধু যাদের চেনেনা ভূমিকা। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছেলে আর কয়েকজন মেয়ে আছে যারা সব স্টুডেন্ডদের নাম লেখছে ভূমিকার হাতে একটা পানির বোতল। সে একটু পর পর পানি খাচ্ছে আর আড় চোখে দিগন্তের দিকে দেখছে। দিগন্তের সাথে চোখাচোখি হতেই নিজের চোখ নামিয়ে নিচ্ছে ভূমিকা। তখন বেশ অস্বস্তিতে পরে মেয়েটা। মনে হয় লুকোচুরি লেখতে গিয়ে ধরা পরেছে এমন অবস্থা। মুখের রিয়্যাকশন পাল্টে যায় ভূমিকার। এই দৃশ্যটা দিগন্ত খুব উপভোগ করে। ভূমিকাকে অস্বস্তিতে ফেলে তার কেমন শান্তি শান্তি ফিল হয়।
-এভাবে বসে বসে পানি খাবি নাকি ওদিকে যাবি আমাদের নামটাও তো লেখাতে হবে তাইনা। নিতুর কথায় ভ্রু কুচকিয়ে সামনে তাকায় ভূমিকা। হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় বোতলের পানি প্রায়ই শেষের দিকে। এত পানি ভূমিকা খেলো কখন ভেবে পায়না। বোতলের মুখটা লাগাতে লাগাতে বলল,
-তোকে আটকিয়ে রাখছে। তুই যা তোর নামটা লেখিয়ে দিয়ে আয়।
-আর তুই??
-আমি কোন পারফরমেন্স করবো না রে। আড় চোখে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা। কিন্তুু দিগন্তকে দেখতে পেলো না সে। দিগন্ত সেখানে ছিলো না। ভূমিকা এদিক ওদিক উকি দিকে দিগন্তকে খুঁজার চেষ্টা করছে। তখনি দিগন্ত ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়ালো আর ওকে টেনে দাঁড় করালো। ঘটনার আকস্মিক ভূমিকা কিছু বুঝে উঠার আগেই দিগন্ত ওর হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। হলরুমে উপস্থিত সকলের নজর এখন দিগন্ত আর ভূমিকার দিকে। দিগন্তের এমন কাজে ভূমিকা এতটাই শকড্ যে শুধু তাকিয়ে আছে দিগন্তের মুখপানে। কিছুটি বলতে পারছে না। অন্যসময় হলে ভূমিকার ভাষন শুনে বিরক্ত হয়ে যেত দিগন্ত। কিন্তু এখন ভূমিকা কিছুই বলছে না। শুধু বুঝার চেষ্টা করছে দিগন্তের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারন। সকলের দিকে নিরবে চোখ বুলিয়ে নিলো ভূমিকা। তখন চোখ পড়লো রুমের এক সাইডে মাহিন দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ খিচে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় দিগন্ত তার পাকা ধানে মই দিয়েছে।ভূমিকার আর বুঝতে বাকি রইলো না দিগন্ত হঠাৎ করে রেগে গেল কেন? হয়তো মাহিন কিছু বলেছে। যাই হোক মাহিন যদি কিছু বলেও থাকে তাতে দিগন্তের কি যায় আসে। সে তো আর ভূমিকাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে মানে না। তাহলে কেন?? সেদিন যদি বন্ধুদের সামনে ভূমিকাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় কিরিয়ে দিতো তাহলো আজ মাহিনের বাজে দৃষ্টি ভূমিকার উপর পড়তো না। এক আকাশ অভিমান এসে ভর করলো ভূমিকার মনে। ছলছল দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকালো। দিগন্ত এখন ক্রোধান্বিত হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দু-চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নিলো ভূমিকা। তারপর একটু নিচের দিকে ঝুকে ব্যাগটা উঠিয়ে সেটা কাদে ঝুলিয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে। ভূমিকা চলে আসাতে দিগন্ত যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করলো সে। তারপর দ্রুত পায়ে মাহিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। দিগন্তকে দেখে মাহিন স্মিত হাসলো। তারপর বলল,
-একটা কাজের মেয়ের প্রতি এত কেয়ার? ওয়াও মিস্টার দিগন্ত তালুকদার। নাকি অন্যকোন রহস্য আছে??
-দেখ মাহিন তোকে লাষ্ট বারের মতো ওয়ার্নিং করছি, ফের যদি ভূৃমির দিকে বাজে নজর দিস তাহলে আমি ভুলে যাব তুই আমার বন্ধু। দিগন্তের কথায় পৈশাচিক হাসি দিলো মাহিন। হাত দিয়ে নিজের চাপ দাড়িয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-ভূলে যা, তোকে মনে রাখতে বলেছে কে?? শুন দিগন্ত ভূমির উপর যখন আমার নজর পড়েছে তাহলে তো ওকে আমার চাই।
-চেষ্টা করে দেখতে পারিস। যদিও জানি সফল হবিনা কখনো।তারপর দুজনের মধ্যে অনেক কথাকাটি হওয়ার পর মাহিন চলে যায় আর দিগন্ত সে তার কাজে মন দেয়।
ড্রয়িংরুমে বসে জুতা খুলেছে আর নিজের রুমের দিকে উকি দিচ্ছে দিগন্ত। তখন ভূমিকার সাথে ওই রকম রুড বিহ্যাভ করাটা ঠিক হয়নি। দিগন্তের ও বা কি করার ছিলো। মাহিনটা কেমন ললাসুদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে ভূমিকার দিকে। দেখেই দিগন্ত গা জ্বলে যাচ্ছিলো। দিগন্তের উকি ঝুকি দেখে মাশহুদ চায়ের কাপ রেখে বলল,
-কি বারবার উকি দিচ্ছিস বলতো। রুমে যা, গিয়ে দেখ বৌমা কি করতাছে। দিগন্ত মাশহুদের দিকে ইনোসেন্ট মুখ করে তাকালো, অতঃপর বলল,
-বাড়িতে সব ঠিকঠাক আছে তো??
-হ্যাঁ, কি আর ওইবো। সব ঠিকই আছে। তুই এহন তোর ঘরে যায়। হাতমুখ ধুইয়া আয়। তারপর সবাই মিলে একসাথে খাইতে বসুম।
আরে আব্বা ঘরে যাই কেমনে বলো। তোমার ঘুণধর বৌমার যে ঝাজ সেটা তো তোমারা জানো না। এখন ঘরে গেলে আমার উপর দিয়ে যে কি ঝড় বইবে সেটা শুধু আমিই জানি। কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করলেও সেটা মুখে প্রকাশ করলো না দিগন্ত। সে তার বাবার দিকে ইনোসেন্ট মুখ করে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো রুমে আসবে বলে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে উকি দিলো। রুম দেখি ঠান্ডা আছে। তাহলে কি ধানিলঙ্কা ঘুমাচ্ছে। বুকের উপর থুঁ থু্ঁ দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো দিগন্ত।এদিকে ছেলের কান্ড দেখে হাসছে মাশহুদ ও তার অর্ধাঙ্গিনী
#বেলা_শেষে। [০৯]
ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে দিগন্ত। রুমের পরিবেশ ঠান্ডা দেখে বড় করে শ্বাস ত্যাক করে সে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখতে পায় ভূমিকা বিছানায় বসে ইকুইটি এন্ড ট্রাস্ট আইন বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। পড়ায় মনোযোগ নেই শুধু বইয়ের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে রাগ পুশে রাখলে যা হয় আর কি। দিগন্ত মৃদু হেসে ভূমিকার পাশে গিয়ে বসলো। ভূমিকা ওকে দেখেও দেখলো না। সে ঘাড় ঘুড়িয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসলো। ভূমিকার মুখের রিয়্যাকশন দেখে খুব হাসি পাচ্ছে দিগন্তর। সে খুব কষ্টে নিজের হাসিটাকে দমিয়ে রাখছে। ভূমিকার হাতের স্প্রিড এবার বেড়ে গেছে। সে দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। দিগন্ত উকি দিয়ে দেখছে ভূমিকার বইয়ের দিকে আর মনে মনে বলছে,
-বেচারা বই, আজ তোর জন্যে আমি বেঁচে আছি এখনও। আমার উপর থাকা সব রাগ তোর উপর ঝাড়ছে। বেঁচে তাকলে দেখা হবে কোনদিন।
বিরক্ত হয়ে ভূমিকা বই রেখে দিলো। শান্ত চোখে দিগন্তের দিকে তাকাতে দিগন্ত বলে উঠলো,
-বইয়ের উপর রাগ ঝাড়ছো কেন?? আমি তো তোমার পাশেই আছি। আমি অন্যায় করেছি যা বলার আমাকে বলো। বেচারা বই মরে গেলে তাতে তোমাই ক্ষতি।
ভূমিকার বুঝতে বাকি রইলো না দিগন্ত তাকে রাগানোর জন্যেই কথাগুলো বলছে। কিন্তুু ভূমিকা সে এখন রাগ করবে না। ভূমিকা তো জানে দিগন্ত তখন কেন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। ভূমিকা শান্ত গলায় বলল,
-আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি আপনার জন্যে চা করে আনছি। এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না ভূমিকা। চলে আসলো রান্নাঘরে। ভূমিকার শান্ত কথায় দিগন্ত শক্। ভূমিকা এতটা শান্ত ভাবে কথা বলবে এটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো। নাকি ভূমিকার এই শান্তকথা বড় কোন বিপদের ইঙ্গিত। একদণ্ড বসলো না সে। ছুটে চলে আসলো রান্নাঘরে। ড্রয়িংরুমের সুফাতেই বসে ছিলো মাশহুদ ওর তার স্ত্রী। ভূমিকার পিছুপিছু দিগন্তকে রান্নাঘরে আসতে দেখে দিগন্তের মা বলল,
-ছেলেমেয়ে দুটোর ভালোই ভাব হয়েছে দেখছি। কেও কাওকে ছাড়া থাকতেই পারছে না। স্ত্রীর কথা হাহা করে হেসে দিলো মাশহুদ তালুকদার। হাসতে হাসতে বলল,
-আমাদের ভূমি মাকে ভালোবাসা না বেসে থাকা যায় নাকি। তবে যাই কও গিন্নী ছেলে কিন্তু বাপের মতোই হয়েছে। প্রেম কুমার। বাপের মতোই ভালোবাসতে শিখেছে।
-তোমার যত আজাইরা কথা। বুড়ো হয়ে গেলে অথচ এখনো তোমার মনের রং গেলো না।
-আর যাবেও না বুঝলে গিন্নী। যার পাশে এমন সুন্দর গুলুমুলো বউ আছে তার মনের রং কোন দিনও যাবে না।
-এই তুমি থামতো। ছেলেমেয়ে দুটো রান্নাঘরেই আছে। তোমার এই কথাবার্তা শুনলে কি ভাববে বলতো।
-ভাববে তাদের বাপ এখনো কতটা,,,,
-এই চুপ। থামতো তুমি।
-আমাকে একটা পান দেও গিন্নী। দিগন্তের মা বসে বসে তার স্বামীর জন্যে পান বানাতে লাগলেন। আর এদিকে ভূমিকা চা বানাচ্ছে আর দিগন্ত ওর পিছন পিছন ঘুড়াঘুরি করছে। আর উকি ঝুকি মারছে। ভূমিকা চা বানাতে বানাতে বলল,
-আপনি আমার পিছুপিছু ঘড়ঘুড় কেন করছেন??
-দেখছি আমার চা-য়ে বিষটিশ মিশিয়ে দাওকি না।
-দিলেও সমস্যা কোথায়। হসপিটাল তো পাশেই আছে।
-তা ঠিক। বাট আমাকে হাসপিটালে নিয়ে যাবে কে?? তুমি নিশ্চয় নিবে না। তুমি আমাকে বিষ খাওয়াবে তো বাঁচানোর জন্যে নয় তাইনা। দিগন্তের এই কথাশুনে ভূমিকার বুকের ভেতরে ছেদ করে উঠলো। হাটদুটো আলগা হয়ে আসলো তার। ভূমিকা দিগন্তকে বিষ দিবে এটা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা সে। দিগন্ত নাই মানুক বিয়েটা তো মিথ্যে হয়ে যাবে না। কালেমা পাঠ করে বিয়ে করেছে। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা। এখানে প্রেম ভালোবাসা সবটাই বৈধ। যত খুশি ভালোবাস তাতে কোন পাপ নেই বরং আর সোয়াব পাওয়া যাবে। এই বন্ধন কি এত সহজে ভাঙে যাবে। না, ভূমিকা কিছুই ভাবতে পারছে না। দিগন্ত তার স্বামী এই সত্যিটা অস্বীকার করার ক্ষমতা তার নেই। ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছে বিয়ের পর একটা মেয়ের কাছে তার স্বামিই সব। স্বামির ঘরই তার নিজের ঘর। তাহলে ভূৃমিকার বেলায় সেই নিয়মেয় ব্যতিক্রম কেন হলো।
চা কাপে ঢেলে সেটা দিগন্তের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, কিছু মিশাই নি নিশ্চিতে খেতে পারেন। তারপর সেখান থেকে প্রস্থান করলো ভূমিকা। দিগন্ত তাকিয়ে আছে ভূমিকার চলে যাওয়ার পানে। আচ্ছা মেয়েটাকি রাগ করলো নাকি। দিগন্ত তো ভূমিকাকে রাগানোর জন্যে বলেছিলো চা-য়ে বিষ মেশানোর কথা। চা-টা আর মুখে তুলল না দিগন্ত। যে করেই হোক ভূমিকার মান ভাঙাতে হবে। চা-এর কাপ সেখানেই রেখে চলে যাওয়ার জন্যে সামনে এক পা বাড়াতেই দিগন্তের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে কল করলো? অনিচ্ছা থাকা সত্তেও পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। মোবাইলের স্কিনে মিমির মানটা জ্বলজ্বল করছে। এই সময় আবার মিমি কেন কল করলো। কল রিসিব করবে কি করবে না দ্বিধায় পড়ে যায় দিগন্ত। ভাবতে ভাবতে কলটা কেটে যায়। দিগন্ত মোবাইলটা পকেটে পুরে রাখে। তারপর রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই আবারও কল আসে। দিগন্ত এবার কল রিসিভ করে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। সুফার এক কোনে বসে দিগন্তকে দেখছিলো ভূমিকা। কল রিসিভ করে দিগন্তের রুমে চলে যাওয়ায় ভূমিকার বুঝতে বাকি রইলো না কে কল করেছে। ঠোঁট চেপে বড় করে শ্বাস নিলো ভূমিকা। সে কিছুতেই দিগন্ত আর মিমির মাঝখানে আসতে পারে না। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, চেয়ারম্যান সত্যিটা না জেনে দিগন্তের সাথে ওর বিয়ে দিয়েছে। এই বিয়ের মেয়াদ কতদিন ঠিক জানা নেই ভূমিকার।
দুপুরের খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে ভূমিকা। মাথাটা আজ ভিষন ভার। অনেকক্ষণ যাবৎ ঘুমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তুু ঘুম পরিরা কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না তার দু- চোখের পাতায়। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। আড়মোড়া হয়ে উঠে বসলো সে। পাশেই ড্রেসিংটেবিলের সামনে চোখ পড়তেই দেখতে পেল দিগন্ত ফরমাল ড্রেসে সেখানে দাঁড়িয়ে শরীরে বডি স্প্রে দিচ্ছে। ভূমিকা তাকিয়ে রইলো সেদিকে কিছুক্ষণ। ওর খুব করে ইচ্ছে করছে দিগন্তের মাথার ওই চুলগুলো নাড়িয়ে এলোমেলো করে দিতে। ভূমিকা যখন দিগন্তের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে পালিয়ে আসতে নিবে তখন দিগন্ত ভূমিকার হাত চেপে ধরবে। আর ওর কাছে মাথা নত করে দিবে। ভূমিকা নিজ হাতে যত্নকরে দিগন্তের মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিবে। নিজের ভাবনার থেকে বেড়িয়ে অন্যদিকে মুখ করে তাকালো ভূমিকা।
আয়নাতে এতক্ষণ যাবৎ ভূমিকাকে দেখছিলো দিগন্ত। আজ একটু অন্যরকম লাগছে ভূমিকাকে। কেমন জানি চুপচাপ, মনে হয় তার অন্তরে বিষন্নতা নেমেছে। এমন চুপচাপ ভুমিকাকে মেনে নিতে পারছে না দিগন্ত। ভূমিকা তো হবে এমন যাকে একটা কথা বললে সে হাজারটা কথা শুনাবে। রাগে কটমট করে তেরে আসবে মারতে। আচ্ছা ভূমিকা এখনো তার উপর রেগে আছে। তাই এত চুপচাপ ম্যাডাম। দিগন্ত ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়ালো তারপর বলল,
-সরি, ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা। দিগন্ত কি এমন করেছে যে, তাকে সরি বলছে।
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার সরি এক্সেপ্ট করো।দিগন্ত সরি বলছে তার আবার জোর গলায়। মানে তার সরি এক্সেপ্ট করতেই হবে। আচ্ছা এভাবে কেও সরি বলে নাকি। সরি তো বলবে মাথা নিচু করে। তার কন্ঠে থাকবে অনুতাপ, অনুরোধ স্পষ্টত। কিন্তু দিগন্তের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে সরি বলে ভূমিকাকে ধন্য করছে। কিন্তু ভূমিকা সেই তো কম কিসে। ভূমিকা বলে উঠলো,
-আপনি কি জোর করে সরি এক্সেপ্ট করাবেন নাকি? আমি করবো না আপনার সরি এক্সেপ্ট। কথাগুলো বসে চুপ করে বসে থাকে ভূমিকা। তারপর মনে মনে বলে, আচ্ছা ওনি আমাকে সরি কেন বলছে। ওনি কি কোন ভুল করছে নাকি। যাই হোক সরি যখন বলছে এবার ওনাকে একটু নাচানো যাক।
-ওও হ্যালো কি এত ভাবছেন??
-ভাবছি আপনি সরি কেন বলছেন। বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো ভূমিকা।
-সত্যিই তো আমি তোমাকে সরি কেন বলছি। ঠোঁট চেপে হেসে বলল দিগন্ত। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, থাংক্স। আর কিছু বলে না ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে চলে যায় দিগন্ত। ভূমিকা রাগে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। আর মনে মনে নিজেকে গালি দিতে থাকে। আরো পার্ট নে। কি দরকার ছিলো দিগন্তকে নিজের মনের কথা বলতে। এবার দিলতো তোকেই বোকা বানিয়ে।
সূর্য মাথার উপর থেকে হেলে পড়েছে। পশ্চিম গগনের দিকে যাচ্ছে যাচ্ছে ভাব। চারিদিকে গোধুলির ন্যায় রাঙা হয়েছে। চারিদিকে নিবিড় নিস্তব্ধ। কোলাহল পূর্ন এই শহরা যে সূর্যের সাথেই হেলে পড়েছে। ভূমিকা চায়ের কাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। বিকালের শহরটা উপভোগ করছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। একাকি সময় কাটানোর জন্যে এর থেকে ভালো কোন ওয়ে জানা নেই ভূমিকার। এমনি সময় মাশহুদের গলার আাওয়াজ শুনতে পেল ভূমিকা। তাদের রুমে দাড়িয়ে মাশহুদ দিগন্তকে ডাকছে। ভূমিকা চায়ের কাপ সেখানেই রেখে রুমের ভিতরে আসলো । ভূমিকাকে দেখে মাশহুদ জিগ্যেস করলো,
-দিগন্ত কই?
-বাহিরে গেছে। কেন আব্বা কিছু লাগবো??
-একটু ডক্তারের কাছে যাওন লাগছিলো। তোমার শ্বাশুড়ির রিপোর্ট তো বিকালে দেওনের কথা। তাই দিগন্তকে খুজছিলাম।
-আচ্ছা আমি আইনা দিতাছি। ভূমিকা রেডি হতে থাকে।
প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পড়িয়ে নিঃশব্দ পায়ে সন্ধা নামে পৃথীবিতে। প্রবিন দিনকে পিছনে ফেলে নতুন এক দিনের সূচনায় পশ্চিম গগনের সূর্য ডুবে যায়। চারিদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসে ক্রমশ অন্ধকারে হতে থাকে। এই আবছা আলোই রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভূমিকা। হাসপিটালে এসে তার শ্বাশুড়ি মায়ের রিপোর্ট গুলো নিয়ে বাসায় ফিরছে এখন। কিন্তুু প্রবলেম হলো সে এই সময়ে রাস্তায় কোন গাড়ি পাচ্ছে না। এদিকে চারিদিকে ক্রমশ অন্ধকারে দুরের দৃশ্যবলি অস্পষ্ট হতে শুরু করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভূমিকা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। গাড়ি আসছে কি না? তখনি একটা বড় গাড়ি এসে থামলো ভূমিকার সামনে। গাড়িটা ভূমিকার সামনে ব্রেক করায় দু পা পিছিয়ে যায় ভূমিকা। কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে গাড়ির দিকে তাকায় সে। রাস্তায় এত জায়গা থাকতে তার সামনে এসেই কেন গাড়ি ব্রেক করলো। ভূমিকাকে অবাকে করে দিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে আরাভ। সে ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভূমিকা অস্ফুটভাবে বলে,
-আরাভ সাহেব আপনি???
ভূমিকার কথায় কিন্চিৎ হেসে নিজের উপস্থিতি স্বিকার করলো আরাভ