#বেলা_শেষে। [১০]
-আপনি এখানে কি করছেন?? তড়িৎগতিতে ভূমিকার ছুঁড়ে দেওয়ার প্রশ্নের কোন জবাবই দিলো না আরাভ। মাথা দুলিয়ে স্মিত হাসলো সে। ভূমিকা ভ্রু কুচকিয়ে সেই হাসির দিকে তাকালো। দু-দু বার প্রশ্ন করার পরেও কোন জবাব দিলো না আরাভ। বিনিময়ে মৃদু হাসলো। ভূমিকা ভেবে পায়না এখানে হাসির কথা কি বলল সে।
-আপনি এখানে কি করছেন?? আরাভের প্রশ্নের জবাব তড়িৎগতিতে দিলো ভূমিকা।
-অপেক্ষা করছি।
আরাভ ভ্রু কুচকিয়ে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলল। ওর মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। ভূমি এখানে কার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভূমিকা হয়তো আরাভের চাওনিটা বুঝতে পারলো। তাই সে বলে ফেলল,
-রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছি। বাসায় ফিরবো তো তাই।
ভূমিকার কথা শুনে বড় করে শ্বাস ছাড়লো আরাভ। এতক্ষণ মনে হয় তার দমটা গলায় আটকে ছিলো। ঠোঁটের কোনে কিন্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো। অধরে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-আমি ড্রপ করে দিবো। না, যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
-আমি কেন আপনার গাড়িতে যাব হুম। একটু পর দেখবেন এদিকে রিক্সার লাইন লেগে যাবে। আপনি যান না যেখানে যাচ্ছিলেন যান।মাথা চুলকালো আরাভ। আর মনে মনে বলল,
-জানতাম মেডাম কিছুতেই আমার গাড়িতে যাবেন না। তাতে মেডামের ইগো হার্ট হবে কি-না। অতঃপর আরাভ ভূমিকার জন্যে একটা রিক্সা ডেকে আনে। ভূমিকা সে রিক্সাতেই উঠে বসে। রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা চালিয়ে ছুটছে। পিছনে থেকে আরাভ তাকিয়ে আছে সেই রিক্সার দিকে। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো আরাভ তার দৃষ্টি নামালো না। রিক্সাটি আরাভের দৃষ্টির অগোচর হতেই স্মিত হেসে বুকের বা পাশটাতে হাত রাখলো। উপর দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলে উঠলো,
-অপেক্ষার শেষটা একদিন সুন্দর হবে, ক্লান্ত হৃদয়টাও একদিন প্রশান্ত হবে, প্রার্থনার আওয়াজ গুলোও একদিন কবুল হবে । দু-ঠোঁট প্রসারিত করে ভূবন ভুলানো হাসি হাসলো আরাভ। তারপর নিজের গাড়িতে করে চলল তার গন্তব্যে।
রিক্সাটি এসে এগারোতলা একটা বিল্ডিং এর সামনে থামালো। ভূমিকা রিক্সা থেকে নেমে তার বাসার দিকে চলে গেলো। এদিকে কেও ওকে ফলো করতে করতে ওর বাসা পর্যন্ত এসেছে সেটা বুঝতেই পারলো না ভূমিকা। ভূমিকা চলে যাওয়ার পর অঞ্জাত ব্যক্তি মাথা থেকে হেলমেড খুলে পৈশাচিক হাসি হাসলো। হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে নিচের ঠোঁটের কোর্নারে স্লাইড করে নিলো।
আজ রাতে দিগন্ত একটু লেট করে বাসায় ফিরে। একে একটু লেট বলে না। রাতের বারোটা বাজে।তবে শহরের মানুষের কাছে এইটুকু সময় লেট করে বাসায় ফেরাটা কোন ফ্যাক্টই না।
গ্রামের সাধারণ মানুষরা যখন সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তখন শহরের আধুনিক মানুষেরা ছুটে যায় ডিক্সে, নাইট ক্লাবে। সেখানে নাচে গান গায় ড্রিংক করে তারপর মাতাল হয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে। এটাই এখন শহরের উচ্চবিত্তদের পরিবারে কালচার। পরিবারের কোন সদস্য এই নিয়মের বাইরে গেলে তাকে গাইয়্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। দিগন্ত আজ গভীর রাতে বাসায় ফিরে। এই নিয়ে মাশহুদ তালুকদার দিগন্তের সাথে অনেক রাগারাগি করে। তার ধারনা রাতে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি না করে সঠিক সময়ে ঘুমিয়ে যাওয়া ভালো। এটা স্বাস্থের জন্যে অনেক ভালো।
সব চেয়ে বড় বিষয় হল, শরীর ও মস্তিষ্ক দু’টিকে সতেজ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনও বিকল্প নেই। এটি মানসিক শান্তি ও সুস্থতা বজায় রাখার পাশাপাশি শারীরিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। যথাযথ ঘুম না হলে অস্বস্তি, বিরক্তিভাব এমনকি ঘন ঘন রাগ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থাৎ অনিদ্রা মানুষের আচরণগত দিককেও প্রভাবিত করে।
মাশহুদের যুক্তিতে কোন ভুলনেই। তাই বাধ্য ছেলের মতো মাথা নতকরে বাবার সব কথা হজম করে নেয় দিগন্ত। ভূমিকা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাশহুদের কথা শুনছিলো। দিগন্তের এমন অসহায় মুখ দেখে খুব হাসি পাচ্ছিলো ভূমিকার। মুখে যতই ফটফট করুক না কেন বাবার সামনে সে ভেজা বেড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর বাহিয়ে নিজেকে শের মনে করে। ভূমিকার এখন বলতে ইচ্ছে করছে বাঁশ বাগানের শেয়াল রাজা দিগন্ত তালুকদার।
ফ্রেশ হয়ে সোজা টেবিলে বসে দিগন্ত। কিন্তুু পড়াতে মন বসে না তার। পেটে ক্ষুধা থাকলে কোন কাজে মন বসে নাকি। আজ রাতে আর খাওয়া হলো না তার। মাশহুদের দেওয়া ঞ্জান শুনেই পেট ভরে গেছে তার। এখন খাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। এদিকে ক্ষুধায় পেটের ভিতরে ইদুর লাফাচ্ছে। উহঃ এক কাপ কফি হলেও মন্দ হতো না। চোখমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে দিগন্ত এমনি সময় কেও তার সামনে চায়ের কাপ ধরলো। দিগন্ত সেই হাত লক্ষ করে সামনে তাকালো, ভূমিকা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দিগন্ত। দিগন্ত ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্নের দৃষ্টিতে ভূমিকার দিকে তাকালো। ভূমিকা ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
-পেটে কিছু পরে নি তাইনা। দিগন্ত ভূমিকার কথার কোন জবাব দিলো না। চায়ের কাপ নিয়ে সেটাতে ওষ্ঠদ্বয় ছোয়ালো।তারপর বলল,
-বিস্কুট থাকলে নিয়ে এসো খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
-বাবা এতো দেখি বসতে দিলে থাকতে চায়। শুনুন চা করে দিয়েছি এটাই অনেক। আর তাছাড়া আপনার কাজ করে দিলে তাতে আমার লাভ কি?? ভূমিকার কথা শুনে ভ্রু কুচকিয়ে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলল দিগন্ত। ভূমিকার কথা কেমন জানি রহস্যে ঘেরা। লাভ ক্ষতির হিসাব করছে, তবে কি ভূমিকার কিছু লাগবে।
-কি চাই তোমার। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল দিগন্ত।
-আমি যা চাইবো তা দিবেন বলুন। উৎসাহ নিয়ে বলল ভূমিকা। দিগন্ত কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করলো।অতঃপর মৌনতা ভেঙে সে বলল,
-ওকে, বলো কি চাই তোমার।
-আমাকে কয়েকটা টিউশন যোগাড় করে দিবেন। মৃদু হেসে বলল ভূমিকা।
-মানে, চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে বলল দিগন্ত। তোমাকে টিউশন যোগাড় করে দিবো আমি। কেন তুমি কি টিউশনি করবে নাকি।
-না আপনার জন্যে খুঁজতেছি। যত্তসব। হ্যাঁ আমি টিউশনি করবো। ভূমিকার কথায় কিছুটা রেগে গেলো দিগন্ত।
-তুমি টিউশানি করবে মানে। তোমার টাকার দরকার সেটা আমাকে বলতে প্রবলেম কি হ্যাঁ। কত টাকা লাগবে তোমার আমাকে বলো। কোন টিউশানি করবে না তুমি।
বলো কত টাকা লাগবে তোমার।
-আমার কোন টাকা লাগবে না মিস্টার দিগন্ত। দু-হাত উঠিয়ে দিগন্ত থামানোর চেষ্টা করে বলল ভূমিকা। আমার কোন টাকা লাগবে না বুঝছেন আপনি। এমনিতেই দিনের পর দিন আপনাদের কাছে ঋনি হয়ে যাচ্ছি। অস্বীকার করতে পারবো না আপনার জন্যেই আজ আমি এই এত বড় কলেজে পড়তে পারছি। এই ঋন কি করে শোধাবো আমি। আমি এই ঋনের বোঝা আর বাড়াতে চাই না। তাই বলছিকি আপনি আমাকে কয়েকটা টিউশানি যোগাড়করে দিন।
-আমি তোমাকে কোন টিউশানি যোগাড় করে দিবো না। আর না তোমাকে টিউশানি করতে দিবো। আমার দায়িত্বে তুমি ঢাকা এসেছো। আমি আমার সব দায়িত্ব পালন করবো। এই শহর সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই ভূমি। তুমি কোন টিউশানি করবে না ব্যস্। দিগন্ত আর কিছু বলল না। উঠে চলে গেলো বারান্দায়। ভূমিকা সেখানেই বসে তাকিয়ে রইলো দিগন্তের চলে যাওয়ার দিকে। তারপর সেও চলে গেলো বারান্দায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই ঘুমান্ত শহর দেখছে দিগন্ত। সারাদিনের কোলাহল পূর্ণ শহর যেন পৃথীবির বুকে রাত নামার সাথে সাথে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চারিদিকে নিবিড় স্তব্ধ, কোথাও কোন মানুষ জনের ছায়াও নেই। চাঁদের জ্যোৎস্নায় জ্বলমল করছে শহরের বড় বড় রং বেরঙের দালানগুলো। বাহিরে দিকে তাকিয়ে ভাবছে দিগন্ত। ভূমিকা হঠাৎ কেন এতটা ইমোশনাল হয়ে গেলো। তখনি নিজের পাশে কারো উপস্থিত ফিল করলো দিগন্ত। দিগন্ত ঘুরে তাকালো না কারন সে জানে তার পাশে এখন ভূমিকা ছাড়া আর কেওই আসবে না।
-আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন??
-তোমার কি মনে হয়না তুমি রাগ করানোর মতো কথা বলছো।
-আপনি আমার দিকটা বুঝতে পারছেন না।
-হয়তো না। কিন্ত তবুও আমি তোমাকে টিউশানি করতে দিবো না। এখন এসব চিন্তা মাথা তেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজের মনকে পড়াশুনায় ফোকাস করো।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আর টিউশনি করার কথা বলবো না। এবার খুশি। ভূমিকা গভীর চোখে তাকালো দিগন্তের দিকে। যেটা দিগন্ত দেখতে পেলো না। দিগন্ত দেখবে কি করে সে তো তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ভূমিকার দৃষ্টি স্থির দিগন্তের মুখের দিকে। আর মাত্র কয়েকটা মাস তার পর থেকেই এই মানুষটাকে আর দেখতে পাবে না সে। দিগন্ত সেটেল হয়ে গেলেই ওদের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটবে। ভাবতেই বুকের পা পাশটা চিনচিন করে ব্যথা করে উঠলো দিগন্তের। বাঙালি মেয়েরা আর যাই হোক স্বামীকে কারো সাথে ভাগ করতে পারে না। ভূমিকা সিদ্ধান্ত নিলো পরে যা হবে ভাবা যাবে। সে এখান থেকে কোথাও যাবে না। আর মন মরা হয়ে থাকবে না। আগের মতো নরমালি আচরন করবে সে দিগন্তের সাথে। ওকে জ্বালাবে হাসাবে আরো কত কি? দিগন্ত যখন থাকবে না এই স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরেই বাকিটা জিবন কাটিয়ে দিবে সে। কারন বাঙালি মেয়ের বিয়ে তো একটাই তাইনা।
-আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। যদি আপনার মনে আমার জন্যে একটু দয়া হয়। তাহলে খেতে দিবে কিছু?
-আমাকে কি কাজের লোক মনে হয় আপনার। কথাটা বলে সামনে তাকাতেই দেখে দিগন্ত ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ভূমিকা তুতলিয়ে বলল,
-আ-আপনার ক্ষিদে পেয়েছে তো। আমি খাবার নিয়ে আসছি ওকে। তারপর তড়িৎগতিতে সেখান থেকে চলে আসে। দিগন্ত স্মিত হেসে বলে,
-আমি সিউর মেয়েটার মাথায় কোন গণ্ডগোল আছে। কে বলবে এতক্ষণ এই মেয়েটা ইমোশনালি কথা বলছিলো। যাই হোক মাথা থেকে টিউশানির ভুত নেমেছে এটাই অনেক।
রান্নাঘরে এসে প্লেটে খাবার সাজিয়ে নেয় ভূমিকা। তখনি ওর মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি আসে। সে তরকারিতে মরিচ আর ভাতে লবন মিশিয়ে নেয়। তারপর ঠোট কামড়ে বলে, আমাকে কাজের লোক বলা তাইনা এবার থেকে বুঝবে মজা। এই ভূমিকার সাথে পাঙ্গা নিয়ে এখনো কেও শান্তিতে বাঁচতে পারে নি। আর মিস্টার বাঁশ বাগানের শিয়াল রাজা আপনাকে তো কখনো শান্তিতে থাকতে দিবো না। ফুঁ দিয়ে কাপলের চুলগুলো উঁড়িয়ে দিয়ে খাবারের প্লেট হাতে চলে আসলো রুমে।
#বেলা_শেষে। [১১]
বেশ উৎসুক নিয়ে খাবার মুখে তুলতেই দিগন্তের মুখের রিয়্যাকশন বদলে গেলো। সে খাবার গিলতেও পারছে না আবার সেটা ফেলতেও পারছে না। ওই কথায় আছে না অল্প সুখে কারত অধীক সুখে পাথর। দিগন্তের এখন হয়েছে সেই অবস্থা। খাবারে যদি শুধু লবন কিংবা শুধু মরিচ থাকতো তাহলে সেটা তাড়াতাড়ি ফেলে দিতে পারতো। কিন্তু এখানে তো লবন মরিচের সংমিশ্রণ পাচ্ছে সে। কোন রকমে খাবারটা মুখ থেকে ফেলে দিলো সে। তারপর ঢগ ঢগ করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। এদিকে দিগন্তের মুখের রিয়্যাকশন দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে ভূমিকা। তার প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে সেই খুশিতে আজ রাতটা সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে করছে তার।গালে হাত রেখে তাকিয়ে আছে সে দিগন্তের মুখের দিকে।ভূমিকার বিজয়ী হাসি দেখে দিগন্তের বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা ভূমিকার কাজ। বেশ রাগী লুকেই ভূমিকার দিকে তাকালো সে। সে দিকে ভূমিকা ভ্রুক্ষেপ হলো না। দিগন্ত প্লেটে পানি ঢালবে এমন সময় ভূমিকা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-এই এই এটা কি করছেন আপনি?? খাবার কেন নষ্ট করছেন?? খাবার নষ্ট করতে নেই। খেয়ে নিন।
-হয়েছে, শেষ । বিরক্তি মুখে বলল দিগন্ত।
-কি??
-তোমার ঞ্জান দেওয়া। নিজেই খাবারটা নষ্ট করে এখানে নাকট করছে। ড্রামা কুইন। বিরবির করে বলল।
-আমি আবার আপনাকে কখন ঞ্জান দিলাম। ভালো কথা বললেই সেটাকে ঞ্জান দেওয়া মনে হয়। শুনুন, এই যে আপনি খাবারটা নষ্ট করছেন। আপনার মতো আরো অনেকে রোজরোজ খাবার নষ্ট করে। এতে করে কত খাবার নষ্ট হয় জানেন আপনি?? আপনি কি জানেন বিশ্বে প্রতিবছর কত খাবার নষ্ট হয়? এর পরিমাণ প্রায় ১৪০ কোটি টন। এই হিসাব জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএওর। সংস্থাটি বলছে, এই নষ্ট হওয়া খাবার বিশ্বে মোট খাদ্য জোগানের এক-তৃতীয়াংশ, যা দিয়ে প্রতিবছর ২০০ কোটি মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব। ভূমিকার কথায় দিগন্ত ওর মুখের দিকে তাকালো। এই মেয়েটা মাঝে মাঝে ঞ্জানের ঝুড়ি খুলে বসে। অতঃপর ভূমিকা আবারও বলতে লাগলো,
-আমরা যখন খাবার নষ্ট করি যখন যদি একবার, একবাট পথ শিশুর কথা মনে করি তাহলে আমরা কিছুতেই খাবার নষ্ট করতাম না। বাংলাদেশে অনেক পথ শিশু আছে যারা খাবারের অভাবে রাস্তায় পরে থাকা উচ্ছিষ্ট খাবার খায়। খাবারের অভাবে যে শিশুটি রাতে না খেয়ে ঘুমাচ্ছে? তার অসহায় বাবা-মা নীরবে চোখের পানি মুছছেন। পৃথিবীর কত মানুষ পেটপুরে দু’বেলা খেতে পায় না, সে হিসাব কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাবে, আর তাই খাবার নষ্ট করার আগে একবার ছোট একটি ক্ষুধার্থ শিশুর মুখ ভাবি, যে হয়ত আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে, একটু খাবারের জন্য। ভূমিকার কথা শুনে নিরবে তাকিয়ে রইলো দিগন্ত। তার এখন না খেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই খাবার সে খেতেও পারবে না। তাই সে খাবারে পানি ঢেলে তার লবনের পরিমান কমিয়ে নিলো। হালকা তরকারি মিশিয়ে খাবারটা খেয়ে নিলো। দিগন্তের খাওয়া শেষে ভুমিকা দু-হাত ঝেড়ে বলল, এটা হলো রাতে লেট করে বাসায় ফেরার শাস্তি।
ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন খন্দকার আদনান মাহবুব। রোজ সকালে তা খবরের কগজ না পড়লেই নয়। সকলে ঘুম থেকে উঠে খবরের কগজ পড়বেন তবেই তিনি শান্ত হবেন। আর সারাদিন হাতে বই নিয়ে বসে থাকবেন। পেশায় তিনি একজন প্রফেসর। যদিও তাদের ফ্যামিলি বিজনেস আছে, তাতে কোন দিনও তার ইন্টারেস্ট ছিলো না। তিনি কখনোও তাদের ফ্যামিলি বিজনেসে জয়েন করেন নি। আগে আদনান মাহবুবের বাবা আজহার এই বিজনেস সামলাতেন। আর এখন তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী খন্দকার জুহায়িন আরাভ তাদের এই বিজনেস দেখাশুনা না। আদনান মাহবুবের বই পড়া নিয়ে জুবাইদার সাথে কম কথাকাটিও হয়নি তার। তবুও তিনি বই পড়া অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন নি। বিয়ের পর পর যখন জুবাইদার কোন জিনিসের প্রয়োজন হতো সে নিজে কিনে নিতো। সখের বসেও আদনানের হাত থেকে তিনি কিছুই পান নি। এই নিয়ে জুবাইদার দুঃখের শেষ নেই।
আদনানের খবরের কাগজ পড়ার মাঝেই আজহার নিচে এসে আদনানের পাশে বসলো। হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়ে জুবাইদাকে ডেকে বলল,
-বৌমা এক কাপ চা দাও তো।
-জ্বি বাবা আসছি। রান্নাঘর থেকে জবাব দিলো জুবাইদা।
জুবাইদা আজহারকে এক কাপ চা দিয়ে তার পাশে দাঁড়ালেন। আজহার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-কিছু বলবে বৌ-মা।
-বাবা আপনার নাতিকে একটু বুঝাননা। কালকেও মেয়েটাকে রিজেক্ট করেছে। এই নিয়ে প্রায় শ খানেক মেয়ে রিজেক্ট করলো। কি চায়ছে ও। ওর বিয়ে করার ইচ্ছে নাই থাকতে পারে। তাই বলেকি আমাদের কোন শখ আহ্লাদ নাই না-কি।
-তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন বৌ-মা। দাদুভাই তো বলেনি সে বিয়ে করবে না। ও একটু সময় চাইছে। ওকে একটু সময় দাও। দেখবে, অপেক্ষার শেষটা সুন্দর হয়। আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলেন আজহার। জুবাইদা চলে গেলো রান্নাঘরে। আদনান এখনো খবরের কাগজে মুখ গুজে আছে। আজহার আদনাকে বললেন,
-তোমার কলেজের কি অবস্থা এখন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে তো?
-আর বলোনা বাবা।খবরের কাগজ পাশে রাখলেন আদনান। তারপর বললেন, তোমার নাতি এবার কি করেছে জানো। আমাদের কলেজে নাকি নবীন বরণ হবে। আদনানের কথা শুনেই চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো আজহারের। শক্তকরে খবরের কাগজ চেপে ধরলেন তিনি। আচ্ছা বাবা তুমিই বলো এতদিনের রিচুয়াল ব্রেক করার কি দরকার ছিলো। আমাদের কলেজে নবীন বরণ হতো না এটাই তো ভালো ছিলো। এখন আবার বাড়তি ঝামেলা।
আজহার কিছু বলবে এমন সময় খেয়াল করলো আরাভ আসছে। সে যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। নাহলে এই ছেলেটা আবার হাজার প্রশ্ন শুরু করবে। তিনি খবরের কাগজে মুখ লুকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,
-দাদুভাই যখন উদ্দোগ নিয়েছে তাহলে এর পিছনে নিশ্চয় কোন কারন আছে। আজহারের এই ভাঙা গলাকে কেও বুঝতে পাড়লো না। আরাভ এসে সবাইকে গুডমর্নিং বলে সোজা ড্রাইনিং এ বসলো। তারপর তার মাকে ডেকে বলল,
-আম্মু জলধি ব্রেকফাস্ট দেও। আমাকে একটু কলেজে যেতে হবে।
-নিজে নিয়ে খা। আমি কেন শুধু তোর ফাইফরমাশ খাটতে যাব। আমার ও তো কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয়। সারাটা জিবন আমি কেন একা একা সব কিছু করতে যাব।
-আব্বুকে বলোনা আরেকটা বিয়ে করে তোমার জন্যে একটা সঙ্গী নিয়ে আসতে। তারপর দুই সতীন মিলে রান্নাবান্না করবা গল্প করবা ঝগড়া করবা মারামারি করবা। দিস ইজ দ্যা বেষ্ট ওয়ে টু ওভারকাম ইউর লোনলেস। কি বলো দাদু। আরাভের কথা শুনে আজহার উঠে এসে আরাভের কান মুলে দিলো। তারপর বলল,
-তুমি থাকতে আমার বুড়ো ছেলেটা কেন বিয়ে করবে শুনি।
-বিকজ, আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। এখন প্রেমের বয়স, আই হ্যাভনট মেইড লাভ বিফোর, দ্যেন আই ওইল থিংক এবাউট মেরেজ।
-কাওকে মনে ধরেছে বুঝি? আরাভের কান ছেড়ে দিয়ে বলল আজহার। আজহারের কথার কোন উত্তর দিলো না আরাভ। বিনিময়ে মৃদু হাসলো। আজহার তার জবাব পেয়ে গেছেন। তিনি একজন সাকসেসফুল বিজনেসম্যান কিনা। মানুষের মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন। শুধু বুঝতে পারেন নি নিজের,,, বড় করে শ্বাস ছেড়ে আবার আগের জায়গায় বসলেন তিনি। আরাভ ব্রেকফাস্ট করে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আজ আবার কোন মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতে হবে সেটা এসএমএস করে জানিয়ে দিও। আগেই বলে রাখালাম এটাও রিজেক্ট হবে। তারপর মায়ের গালে একখান চুমু দিয়ে বেড়িয়ে যায় সে।
হলরুমের এক সাইডে দাঁড়িয়ে সবার ডান্স পারফরমেন্স দেখছে ভূমিকা। ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দিগন্তের বন্ধুরা। যারা সবাইকে নাচের স্টেপ দেখিয়ে দিচ্ছে। দিগন্ত এখানে নেই। হয়তো মিমির সাথে একাকি টাইম স্পেন্ড করতে গেছে। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো ভূমিকা। হঠাৎ নওশাদের চোখ পরে ভূমিকার উপর। ভূমিকা কেমন মন মরা হয়ে একাকি দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ ভূমিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
-তুমি পারফরমেন্স করবে না।
-না। কাটকাট জবাব দিলো ভূমিকা।
-ওহ। আচ্ছা তুমি থাকো কোথায়?? নওশাদের কথায় ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা তারপর বলল,
-যেখানে থাকার কথা।
-কোথায় থাকার কথা। ভ্রু নাচিয়ে বলল নওশাদ।
-যেখানে থাকি। ভূমিকাকে আর কোন প্রশ্ন করলো না নওশাদ। কারন ভূমিকা যে তাকে সঠিক প্রশ্নের জবাব দিবে না সেটা ভালো করেই বুঝে গেছে সে। কিছু একটা মনে পড়তেই ভূমিকা বলল,
-আপনার হাতের কাগজটাতে কি সকলের নাম দেওয়া আছে।
-না, শুধু যে যে ডান্স করবে তাদের লিষ্ট এটা।
-ওহ আচ্ছা। আমি কি একটু লিষ্টটা দেখতে পারি। অতঃপর নওশাদ ভূমিকার হাতে লিষ্ট ধরিয়ে দিলো। ভূমিকা এক এক করে সকলের নাম দেখছে। এদের মধ্যে আবার অনেকে আছে যা কাপল ডান্স করবে। কিংবা দলীয় নাচ করবে। সকলের নাম দেখছে ভূমিকা। হঠাৎ একটা নামে এসে তার চোখ আটকিয়ে যায়। দিগন্ত ডান্স করবে। তার পাশেই দেখতে পায় মিমির আর তাদের কয়েকজন বন্ধুর নাম। দিগন্ত ওর বন্ধুদের নিয়ে দলীয় নাচ করবে। তবে প্রত্যেকের একজন করে পার্টনার থাকবে। যেমন দিগন্তের পার্টনার মিমি, তপুর পার্টনার জ্যোতি।দিগন্ত মিমির সাথে ডান্স করবে। কথাটা ভাবতেই ভূমিকার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। সে লিষ্টটা নওশাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে আসলো ক্যাম্পাসে। সেখানে অনেক খুজার পর রাতুলকে পেল সে। তারপর রাতুলের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলো,
-তুই নাচতে পারিস।
হঠাৎ ভূমিকার এমন প্রশ্নে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় রাতুল। তারপর বলে, কিসের নাচ।
-বাদুর নাচ।গাধা কোথাকার, আমারা একসাথে নাচবো পারিস তুই।
-ওই একটু একটু আরকি।
-তাতেই চলবে। বলেই রাতুলের হাত ধরে টেনে হলরুমে নিয়ে যায় আর ডান্স পারফরমেন্সে ওদের নাম লেখায়। রাতুল আর ভূমিকা দু-জনেই ডান্স করবে।
রাতুলের সাথে ভূমিকা ডান্স করছে। হলরুমের সকলে ওদের নাচের স্টেপ গুলো দেখছে। সাধারণ কাপলদের মতো ডান্স করছে না। একে অপরকে না ছুঁয়ে দুটো দুটো মোট চারটি কাঠির মাধ্যমে ডান্স করছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভূমিকার ডান্স দেখছে আরাভ। আরাভ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো অফিসরুমে, ভূমিকার ডান্স পারফরমেন্স দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় সে। এদিকে ভূমিকাকে দেখে রাগে ফুসছে মাহিন। সে মনে মনে ফন্দি আটে ভূমিকাকে কি করে কষ্ট দেওয়া যায়। পানি খাওয়ার নাম করে টেবিলের উপর থেকে বোতল হাতে নেয় সে। তারপর ওদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নাম করে কিছুটা পানি ফ্লোরে ফেলে। যাতে ওরা দু জনেই পানিতে পা পিছলে নিচে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত সেটাই হলো। তবে দুজনে না ভূমিকা একা সেই পানিতে পা রাখলো।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আরাভ যখন লক্ষ করলো ভূমিকার পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। ওমনি আরাভ দৌড়ে এসে ভূমিকার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ভূমিকা ভয় পেয়ে আরাভের টি শার্ট খামছে ধরলো।
#বেলা_শেষে। [১২]
দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে অনুষ্ঠানের দিন। মাশহুদ তালুকদার তার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। দিগন্ত আর ভূমিকা দুজনে এখন আলাদা রুমেই থাকে। ভূমিকা এখন দিগন্তের সাথে প্রয়োজনের বাহিরে তেমন কথা বলে না। কি দরকার আছে শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে। সেদিনের পর থেকে ভূমিকাও এই সত্যিটা মেনে নিয়েছে। যার প্রতি মায়া বাড়িয়ে কোন লাভ নেই, সেখানে মায়া না বাড়িয়ে মায়া কাটাতে শিখতে হয়। ভূমিকার এখন একটাই লক্ষ মন দিয়ে পড়াশুনা করে অনেক বড় আইনজীবী হওয়া। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে ভূমিকা। আজ ওদের কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান। সবাই মিলে ঠিক করেছে মিষ্টি কালারের শাড়ি পড়ার। ভূমিকাও আজ মিষ্টি কালারের শাড়ি পড়েছে। শাড়ির আঁচল ঠিক করা শেষ হলে মাথার চুলগুলো বেনুনি করে কাদের এক সাইডে নামিয়ে দিলো। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো। ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। তারপর দু-হাত ভর্তি চুড়ি পড়ে আয়নাতে নিজেকে একবার দেখে নিলো ভূমিকা। না মন্দ লাগছে না তাকে। বেশ ভালোই লাগছে। এখন তার মা থাকলে কত কি যে করতো। পুরনো দিনের লোকের মত করে শরীরের কোন এক অংশে কালি লাগিয়ে দিতো না হলে শুকনো মরিচ পুরো শরীরের চারিদিকে ঘুড়িয়ে সেটা পুড়িয়ে দিতো। যাতে ওর উপর কারো নজর না পরে। মায়ের সেই বাচ্চামোর কথা মনে পড়তেই মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর বিরবির করে বলল,
-খুব শিগগীরি তোমাদের কাছে ফিরে আসবো মা।
অতঃপর ভূমিকা কলেজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়। দিগন্ত ওর আগেই বেড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু দিগন্তদের উপর দায়িত্ব পড়েছে তাই ওকে আগেই যেতে হয়েছে।
দিগন্ত ও তার বন্ধুরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রধান অতিথির জন্যে। এই কলেজে প্রধান অতিথি হয়ে আছেন, বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী খন্দকার আজহার মওদুদ। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে স্যারদের সাথে কথা বলছে আরাভ। এই অনুষ্টানের সমস্ত ভালো মন্দ দেখভালের দায়িত্ব তার। সকলে মিলে যখন প্রধান অতিথির জন্যে অপেক্ষা করছে তখনি কলেজে আগমন ঘটে ভূমিকার। মিষ্টি কালারের শাড়ি আর গর্জিয়াছ সাজে ভূমিকাকে একদম পরির মতো লাগছে। ভূমিকাকে এই রুপ দেখে ভ্রু কুচকিয়ে ভূমিকার দিকে তাকালো দিগন্ত। এর আগে কখনো ভূমিকাকে এই সাজে দেখেনি সে। দিগন্তের নজর বারবারই তার প্রিয়সি মিমির দিকেই ছিলো। তাছাড়া অন্যকোন মেয়ের দিকে খুব একটা নজর দেয়না সে। এমনকি ভূমিকার দিকেও নয়। ভূমিকা দিগন্তের চোখের নজর এড়িয়ে চলে আসলো কলেজের ভেতরে। মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে নিতু আর রাতুলকে খুজছে ভূমিকা। এদিকে আরাভ কথা বলার ফাঁকে লক্ষ করলো মাঠের এক পাশে আসমানি পরি নেমে আসছে। সে কয়েকটা পা এগিয়ে গেলো সেই পরির দিকে। ততক্ষণে নিতু আর রাতুল এসে গেছে। রাতুল এসে ভূমিকার সামনে দাঁড়িয়েছে। যার কারনে আরাভ পরিটাকে দেখতে পারছে না। শুধু বাতাশে দোল খাওয়া শাড়ির আচল দেখতে পাচ্ছে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েগেছে। আজহার মাওদুদ আসার দশ মিনিটের মধ্য অনুষ্ঠান শুরু হয়েগেছে। প্রধান অতিথী কে নিয়ে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।যারা যারা গানে নাম দিয়েছে তারা সকলে গাইছে। এবার ডান্স পারফরমেন্স হবে। ভূমিকা রাতুলকে নিয়ে মেকাপ রুমে চলে যায়। কারন তার ডান্সের জন্যে তাকে নতুন করে মেকাপ করতে হবে। এদিকে ভূমিকাকে ফলো করছে মাহিন। আজই সুযোগ, সকলে অনুষ্টানের জাঁকজমকে ব্যস্ত। এই সুযোগ মাহিন কিছুতেই মিছ করতে চায়না। রাতুল আর ভূমিকা মেকাপ রুমে যাওয়ার পর এদিকে সকলে ডান্স পারফরমেন্স করতে থাকে। দিগন্তের মিমির ডান্সও শুরু হয়ে যায়। সকলে মুগ্ধ হয়ে ওদের কাপল ডান্স দেখে। মিমি আর দিগন্তের সম্পর্কের কথা প্রায় পুরো কলেজের সকলের কাছে জানা। তিন বছরের রিলেশন ওদের। আজকের ডান্স পারফরমেন্সের পর ওদের সেরা কাপল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এবার একটা দলীয় নৃত্য পরিবেশন হবে। এটা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে মেয়েরা মিলে করছে। তারপরেই হবে ভূমিকা আর রাতুলের পারফরমেন্স। ভূমিকা শাড়ি চেঞ্জ করে একটা লেহেঙ্গা পড়ে নেয়। তার সাথে সিম্পল কিছু জুয়েলারি পরে রেডি হয়ে স্টেজের পাশে এসে দাঁড়ায়। দলীয় নৃত্যটা করা হয়েছে রবি ঠাকুরের মন মোর মেঘেরও সঙ্গী গানের সাথে। গানটা যেমন অসাধারণ তেমনি অসাধারণ ভাবে নাচের প্রতিটা স্টেপ তুলে ধরা হয়েছে। ভূমিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দলীয় নৃত্য দেখছে।
দলীয় নৃত্য পরিবেশন শেষ হলে, ভূমিকা আর রাতুলের নাম এনাউজমেন্ট করা হয়। পরপর দু-বার নাম ডাকার পর ভূমিকা রাতুলকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সে রাতুলকে তার আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না। এদিকে বারবার ভূমিকার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। ভূমিকা স্টেজে উঠে দাঁড়ালো আর অপেক্ষা করতে লাগলো রাতুলের জন্যে। প্রায় মিনিট দশেক স্টেজে দাঁড়িয়ে রইলো ভূমিকা কিন্তু রাতুলের দেখা মিলল না। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভূমিকার দিকে। ভূমিকার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে এখন। এবং লজ্জাও লাগছে। এই রাতুলটাও না এই সময়ে আবার কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো। একবার শুধু সামনে পাই তারপর দেখাবো ওকে মজা। ভূমিকার ভাবনার ছেদ ঘটলো দিগন্তের কথায়,
-রাতুল নেই তুমি স্টেজ থেকে নেমে এসো আর না হলে একা কোন ডান্স পারফরমেন্স করো।
দিগন্তের কথায় স্মিত হাসলো ভূমিকা, কেন হাসলো সেটা জানা নেই তার।তারপর দিগন্তের দিকে ভালো করে লক্ষ করলো। মিমি দিগন্তের এক হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় করে শ্বাস নিলো ভূমিকা, তারপর মাথা নিচু করে স্টেজ থেকে নামে আসলো। স্টেজ থেকে নেমে দু- পা সামনে আসতেই আরাভ এসে ভূমিকার একটা হাত ধরলো। আরাভ ভূমিকার হাত ধরেছে দেখেই ভূমিকার গা জ্বলে যাচ্ছে। রাগে কটমট করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে আরাভ বলল,
-হাত ধরার জন্যে সরি। চলুন পারফরমেন্স করবেন??
-মানে??
ভূমিকার কথার জবাব দিলো না আরাভ। ভূমিকাকে টেনে নিয়ে সোজা স্টেজে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দু-হাতে স্টিক নিয়ে বলল,
-সেদিনের স্টেপগুলোই তো।
-হুম। বলেই দিগন্তের দিকে তাকালো ভূমিকা। দিগন্ত বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভূমিকা তার নজর নামিয়ে সামনে তাকালো।
তারপর দুজনে মিলে কাঠি দিয়ে কাপল ডান্স করতে লাগলো। এদিকে স্টেজের উপর আরাভকে দেখে সকলে শকড্। পাচ বছর এই কলেজে পড়াশুনা করেছে আরাভ। কখনো কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেনি ওকে। আর এখন কিনা সে একটা মেয়ের সাথে ডান্স করছে। আরাভের সাথে ভূমিকাকে ডান্স করতে দেখে দিগন্তের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। তবুও ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। আজহার মাওদুদ তার নাতির ডান্স পারফরমেন্স দেখে মুখ টিপে টিপে আসছে। এতক্ষণ একটা টেনশনের মধ্যে থাকলেও এখন তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। ভূমিকা আর আরাভের ডান্স শেষ হলে ভূমিকা দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে আসে। আরাভ সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চারিদিকে সবার করতালি আর উল্লাস দেখে মৃদু হাসে আরাভ। তারপর সেও নেমে আসে।
ভূমিকা দৌড়ে স্টেজ থেকে অনেকটা দূরে চলে যায়।পুকুরের কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর পুকুরের পানিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
-যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে কি পাড়তো না এই লজ্জার হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে। কেন অন্য একজনকে এসে সাহায্যের হাত বাড়াতে হলো। দু-চোখ বন্ধকরে নিলো ভূমিকা। আর তখনি দিগন্ত আর মিমি দুজনের হাসিমুখ দেখতে পায় সে। চট করে চোখ খুলে ভূমিকা আর মনে মনে বলে, আমি একটু বেশীই ভাবছি, গত পাচ মাসে যেটা হয়নি সেটা আধো হওয়ার সম্ভবনা নেই।
আন্টি আমার বেলুনটা একটু এনে দাওনা। একটা ছোট বাচ্চা ভূমিকার লেহেঙ্গা টেনে বলল।ভূমিকা নিচের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে দেখেই মৃদু হাসলো। তারপর বাচ্চাটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-তোমার বেলুন কোথায়??
-উপরে একটা আংকেল নিয়ে গেছে। বলছে তুমি না গেলে সে আমাকে বেলুন দিবে না।
বাচ্চাটার কথা শুনে ভূমিকা কাপাল কুচকালো। আমি না গেলে বেলুন দিবে না। কিন্তু কেন?? কে নিয়েছে বেলুন? ব্যপারটা সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে।
-আচ্ছা কোথায় নিয়ে গেছে তোমার বেলুন? বাচ্চাটি তার হাতের ইশারায় তিনতালার একটা রুম দেখিয়ে দিলো। অতঃপর ভূমিকা চলে যায় বেলুন আনতে।
রুমের ভেতরে ডুকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুতেই দেখতে পেল না সে। দরজা খুলার পরে একটু আলো পেয়েছে। এখানে তো অন্দকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছি না। দরজাটা পুরো খুলে দিলো ভূমিকা। কারন সেখানে সামান্যতম আলো আছে সেখানে অন্ধকার কিছুতেই জিততে পারে না।
-আরে বেবী আসো আসো। আমি তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি। পুরুষনালী ভয়েজ শুনে থমকে দাঁড়ায় ভূমিকা। কারন এটা তার পরিচিতি কন্ঠ। ভূমিকা শক্ত গলায় বলল,
-মাহিন আপনি???
-চিনতে পেরেছো তাহলে। রুমের লাইট অন করে দিলো মাহিন। তারপর এসে দরজাটা লক করে দিলো। ভূমিকা মাহিনকে আটকাতে ব্যস্ত।
-কি করছেন আপনি দরজা কেন আটকাচ্ছেন??
-সেদিন যেটা অসমাপ্ত ছিলো আজ সেটার সমাপ্তি হবে।বলেই পৈশাচিক হাসি হাসলো মাহিন। মাহিনের কথা শুনে বুকটা ছেদ করে উঠলো ভূমিকার। তবে কি হেরে যাবে সে। না সব কিছু এভাবে শেষ হতে পারে। আমি হারবো না। দুর্বল নই আমি। আমি কিছুতেই হারতে পারিনা। ভূমিকার চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। যেখানে সব মেয়েরা নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্যে অপর মানুষটার হাতে পায়ে ধরে আকুতি মিনতি করতে থাকে। সেখানে ভূমিকা নিজেকে তৈরী করছে লড়াই করার জন্যে। তবে কি ভূমিকা পারবে নিজের সম্মান রক্ষা করতে। নাকি এই পুরুষ শাসিত সমাজের কাছে হেরে যাবে সে।
[আসসালামু আলাইকুম। জানি গল্পের পার্টটা এলোমেলো হয়েগেছে। তবুও আপানদের মতামত জানতে চাই। দয়া করে কেও বাজে কমেন্ট করবেন না।
#বেলা_শেষে। [১৩]
- আহা জানেমান কি করছো। ওটা নিচে রাখো বলছি। আজ নিজেকে শেষ করে দিয়েও আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। কথাগুলো বলেই পৈশাচিক হাসি দিলো মাহিন।মাহিনের কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে স্মিত হাসলো ভূৃমিকা। তারপর বলল,
-তোর কি মনে হয় আমি নিজেকে শেষ করে দিবো? তোর ভয়ে আমি আমার প্রান দিবো। যদি তুই এটাই ভেবে থাকিস তাহলে ভুল ভাবছিস।তোদের কাছে আমার প্রাণের মূল্য নাই থাকতে পারে। কিন্ত আমার পরিবার আছে, আপনজন জন আছে। আমি জানি আমি কতটা মূল্যবান তাদের কাছে।তোর মতো একটা অমানুষের জন্যে নিজের শেষ করে দিবো সেটা ভাবলি কি করে। গ্রামের মেয়ে আমি। এই হাতে যে ভাবে কলম চালাতে পারি ঠিক সেই ভাবে লাঠিও চালাতে পারি আমি। বিশ্বাস কর তোর মতো নরকীটকে মারতে আমার একটুও খারাপ লাগবে না।শুধু একটাই আফসোস হবে আমার নামের সাথে খুনি শব্দটা জুরে যাবে। যেটা আমি কিছুতেই চাইনা। কিন্তুু, কিন্তুু তোর মতো নরকের কীটকে মেরে খুনি তকমা পেয়েও গর্ব করে বাঁচতে পারবো। আমি আমার সম্মান নষ্ট হতে দেয়নি।মেরে ফেলেছি তাকে চিৎকার করে কথাগুলো বলে ওয়াইনের বোতলটা দেয়ালের সাথে বারি দিয়ে ভেঙে নিলো।
ওয়াইনের বোতলগুলো মাহিন নিয়ে এসেছিলো। কেননা ড্রিংক করে মৌন নেশাটা বেশী উপভোগ করা যায়। ভূমিকা চোখমুখ শক্তকরে দাঁড়িয়ে রাগে কাপাকাপি করছে। ওর একহাতে ভাঙা ওয়াইনের বোতল। মাহিন শয়তানি হাসি হাসলো। হাত দিয়ে দাড়িতে হাত বুলিয়ে ভূমিকার কাছে আসতে আসতে বলল,
-এই তেজের জন্যেই তোমার এতটা ভালো লাগে আমার। আমি তোমার সব তেজ শেষ করে দিবো। ভূমিকার কাছে এসে দাঁড়ালে ভূমিকা ভাঙা বোতল দিয়ে মাহিনকে আঘাত করতে নেয়। আনফোরটোনাটলি মাহিন ভূমিকার হাত ধরে ফেলে। তারপর ভূমিকার হাত থেকে বোতলা টা নিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ভূমিকা রাগে কটমট করছে আর নিজেকে ছাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মাহিন ভূমিকাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। ভূমিকা শত ধস্তাধস্তি করেও নিজেকে ছাড়াতে পারে না। পা দিয়ে এলোপাথাড়ি লাথি দিচ্ছে মাহিনকে তখনি ভূৃমিকার পায়ের সাথে একটা লাঠি সংঘর্ষণ হয়। ভূমিকা নিজেকে শান্তকরে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। মাহিন মুচকি হাসে তার ধারনা ভূৃমিকে নিজেকে তার কাছে সুপে দিয়েছে। ভূমিকা লাঠিটা তার পায়ে বাজিয়ে নিঃশব্দ উঠেয়ে হাতে নেয়।তারপর মাহিনের মাথার পিছনের দিকে আঘাত করে। ঘটনাক্রমে মাহিন মাথায় হাত দিয়ে পিছিয়ে যায়। আর ভূমিকা মাহিনকে লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। একসময় মাহিন লাঠিটা ভূমিকার হাত থেকে নিয়ে সেটা দূরে ছুঁড়ে দেয়। তখনি ভূমিকা একটা ওয়াইনের বোতল নিয়ে সেটা দিয়ে মাহিনের মাথায় আঘাত করে। আর মাহিনের মাথায় কেটে সেখান থেকো রক্ত ঝরতে থাকে। মাহিন ফ্লোরে শুয়ে পরে। ভূমিকা বোতলটা হাত থেকে ফেলে দিলো। তারপর বলল,,
এই নরকের কীটটা কি মরে গেলো নাকি। এই মরলে তো আবার আমাকে জেলে যেতে হবে। এই রকম একটা পশুর জন্যে আমি কেন শাস্তি পাবো। এই কাচের বোতল দিয়ে মারাটা ঠিক হবে না। তারপর সে আবার লাঠি নিজের হাতে তুলে নিলো আর মাহিনকে মারতে লাগলো।
এদিকে সেই বাচ্চাটা এখনো পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মা তাকে নিয়ে যেতে চাইলে সে বলছে, আন্টি আমার বেলুন আনবে তারপর যাবো। বাচ্চাটির মা কিছুই বুঝতে পারছে না। কিসের আন্টি কিসের বেলুন। সে মাথায় হাত দিয়ে বাচ্চার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আসলে বাচ্চাদের মন খুব স্বচ্ছ আর পবিত্র। তারা একবার যেটা বিশ্বাস করে ফেলে, শত চেষ্টাকরেও সেই বিশ্বাস থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে না। যেমন এখন এই বাচ্চাটি, এখন বিশ্বাস করছে ভূমিকা তার বেলুন নিয়ে আসবে মানে আসবেই। সে এই বিশ্বাসটাই নিয়ে এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
-বৈশাখী, তুই এখানে?? পুকুরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আরাভ। আরাভে কন্ঠশ্বর শুনে উৎসুক দৃষ্টিতে সামনে তাকালো সেই বাচ্চাটির মা। তারপর অভিমানী গলায় বলল,
-বৈশাখী নয় বৈশালী। তোকে কতবার বলবো আমাকে বৈশাখী ডাকবি না।
-ওই একই হলো। আমাদের মামা কোথায়?? [বৈশালী আরাভের কলেজ ফ্রেন্ড]
-ওই তো। বৈশালী তার বাচ্চাটাকে ইশারায় দেখিয়ে বলল। বাচ্চাটাকে দেখে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলো। বৈশালী আর তার বাচ্চাকে নিয়ে আরাভ ভিতরে যেতে চাইলে বাচ্চাটা জেদ ধরে বসে তার বেলুন নিয়ে না আসলে সে কোথাও যাবে না। আরাভ জিগ্যেস করে কে তোমার বেলুন নিয়েছে??
-ওই পচা আংকেলটা। আন্টি গেলে বেলুন আনতে?? বাচ্চাটার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছে না আরাভ। আংকেল বেলুন নিছে, আন্টি বেলুন আনতে গেছে। ব্যপারটা তার কাছে কেমন জানি খটকা লাগছে। আরাভ আবারও জিগ্যেস করলো,
-কোথায় তোমার বেলুন, মামা?? বাচ্চাটা এবারও সেই একই রুমটা দেখিয়ে দেয়। আরাভ বাচ্চাটাকে তার কোল থেকে নামিয়ে বৈশালী বলে,
-একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি। আরাভ তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে চলে আসে। তার গন্তব্য এখন ওই বদ্ধ রুমটা। এদিকে দিগন্ত অনেক্ষণ হলো ভূমিকাকে দেখতে পায়নি। তাই সেও খুঁজছে ভূমিকাকে। আরাভ আর দিগন্ত দু-জনেই ভূমিকাকে খুজছে। শিড়ির কাছে আসতেই দু-জনের মাঝে ধাক্কা লাগে। দিগন্ত আরাভকে সরি বলে, পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আরাভ দিগন্তকে ডেকে দাঁড় করায়। তারপর দিগন্তকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় সেই বন্ধরুমের কাছে। রুমের কাছে এসে দিগন্ত দরজায় টুকা দিলো। তখন দেখলো দরজা ভেতর থেকে লক করা কিন্ত ভিতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না কেও।
-ভাই এখন কি করবো?? দরজা তো ভিতর থেকে লক করা।
-ভাংতে হবে?? আরাভ দরজায় কয়েকটা ধাক্কাদিলো কিন্ত কোন কাজই হলো না।শুধু মাত্র তার এনার্জি লস ছাড়া। তারপর দিগন্তকে বলল,স্ক্রু ড্রাইভার লাগবো। ব্যবস্থা করো কুইক। দিগন্ত নওশাদকে কল করে স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে আসতে বলল। ততক্ষণ ওরা দুজনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় দশ মিনিট পর নওশাদ আর তপু আসলো স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে। ওদের পিছন পিছন আসলো মিমি। নওশাদ স্ক্রু ড্রাইভার দিলে আরাভ নিজে একটা জানালা খুলে। জানালার ভেতর দিয়ে সবাই ক্লাসরুমের ভেতরে প্রবেশ করে
ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলে শকড্ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ওদের সামনে ফ্লোরে নিথর হয়ে শুয়ে আছে মাহিন।কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে তার। আর তার থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে ফ্লোরে হাটুগেরে বসে আছে ভূমিকা মাহিনকে মারতে মারতে নিজেই ক্লান্তহয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। নওশাদ আর তপু অস্ফুটভাবে বলল, ভূমি মাহিন তোরা এখানে??
- ভূমিকা ওদের সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে আবার মাহিনের দিকে তাকায়। মাহিন মাথাটা হালকা উচু করে সবাইকে দেখে আবার আগের ন্যায় শুয়ে পড়ে। মিমি গিয়ে ভূমিকাকে উঠিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ভূমিকার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
-তুমি ঠিক আছো?? বিনিময়ে ভূমিকা মাথা নাড়ায়। আরাভ চোখমুখে ক্রোধ নিয়ে হাতের মুঠি শক্তকরে দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ আর তপু গিয়ে মাহিনকে উঠিয়ে নেয়। উঠে দাঁড়াতেই মাহিন ওদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। ব্যাটা বজ্জাত এত মার খেয়েও দম কমেনি। দিগন্ত মাহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-আগেই বলেছিলাম, ভূমির পিছনে লাগিস না। নিজের বিপদ ডেকে আনিস না দিগন্তের কথা শুনে শয়তানি হাসি দিলো আরাভ। বাম হাত দিয়ে কপালের রক্তমুছে থুঁথুঁ ফেলল। তারপর বলল,
-আমার আগেই বুঝা উচিৎ ছিলো, ভূমি শুধু তোকে সার্ভিস দিবে। আড় চোখে মিমির দিকে তাকিয়ে বলল।
-ভদ্রভাবে কথা বল মাহিন। ধমক দিয়ে বলল দিগন্ত।
-ভদ্র, কাকে ভদ্রতা দিয়ে কথা বলবো তোকে নাকি তোর ওই কাজের মেয়েকে। যে কিনা কাজের নাম করে রাতের পর রাত তোর সাথে কাটায়। তুই অস্বীকার করতে পারবি, ভূমি তোর সাথে থাকে না।কেন দিনের পর রাত, রাতের পর দিন তোর বাসায় থাকে ওই মেয়েটা। কি সম্পর্ক তোদের?? নাকি আমি ধরে নিবো ভূমি কাজের মেয়ে নামক তোর রক্ষিতা। মাহিনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় দিগন্ত। ভূৃমিকা তার দু-চোখ বন্ধকরে নিলো। তাকে এই রকম বাজে কথাও শুনতে হলো। খুব কান্না পাচ্ছে তার। অশ্রুসিক্ত নয়নে দিগন্তের দিকে তাকালো সে। শুধু একটা উত্তরের আশায়। দিগন্ত কি আজও সত্যিটা বলবে না। সবার সামনে তাকে রক্ষিতাই বানিয়ে দিবে। দিগন্ত কিছু বলছে না নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাভ নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। মাহিনের কলার চেপে ধরলো সোজা। তারপর হাতের মুঠি শক্তকরে উঠালো মাহিনের নাক বরাবার ঘুষি দেওয়ার জন্যে। কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে দিগন্ত বলে উঠলো,
-ভূমি আমার স্ত্রী। পরপর কয়েকবার এই শব্দ তিনটে আরাভ এর কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। হাতের মুঠি নামিলে নিলো সে। তারপর তাকালো দিগন্তের দিকে, দিগন্ত আবারও বলল,
-হ্যাঁ এটাই সত্যি ভূমি আর আমার বিয়ে হয়েছে। আরাভ এবার ভূমিকার দিকালো। ভূমিকা তখন নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মিমি দিগন্তের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-এসব তুমি কি বলছো দিগন্ত। তোমার বিয়ে হয়েগেছে মানে?? তুমি মিথ্যে বলছো তাইনা। এই মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে বলছো এসব। কি হলো দিগন্ত চুপ করে আছো কেন?? বল তুমি যা বলছো সব মিথ্যে।
-মিথ্যে নয় সব সত্যি। দিগন্তের এই কথাটা শুনে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নওশাদ বলে উঠলো,
-তাহলে সে দিন ভূমিকে কাজের লোক হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিলি কেন?? নওশাদের প্রশ্ন শুনের করুন চোখে মিমির দিকে তাকালো দিগন্ত। তারপর অস্পষ্ট ভাবে বলল,
-আমি মিমিকে হারাতে চাইনা তাই। দিগন্তের কথা শুনে এক সেকেন্ড ও অপেক্ষা করলো না মিমি। কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে গেলো। দিগন্ত মিমি পিছনে ছুটলো।তারপর একে একে সবাই প্রস্থান করে। ভূমিকাও চলে আসে। সবাই চলে আসার পর আরাভ দেয়ালে একটা ঘুষি দেয়। যার কারনে তার হাত কেটে যায়। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার।তার কানের কাছে শুধু একটা কথাই বেজে যাচ্ছে ভূৃমি আমার স্ত্রী।
তারপর কেটেগেছে তিনদিন। এর মধ্যে দিগন্তের সাথে কোন কথা হয়নি তার। বেশীরভাগ সময় রুমেই কাটিয়েছে সে। কলেজেও যায়নি। দিগন্ত সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকতো। কেননা মিমি তার সাথে কথা বলছে না। ভূমিকা ঠিক করেছে সে সব ঠিক করে দিবে। আজ সকাল সকাল কলেজে চলে যায় সে। বাসা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় দিগন্ত ড্রয়িংরুমেই ছিলো। তবুও কেও কারো সাথে কথা বলেনি।
সবাই যখন একসাথে ব্রেকফাস্ট করছিলো তখন জুবাইদা আজহারকে বলল,
-বাবা আপনার নাতিকে একটু বুঝান না। আমার বান্ধুবির মেয়েটা অনেক ভালো। যেমন সুন্দর তেমনি শিক্ষিতা। ওকে একটু বলুন না মেয়েটার সাথে দেখা করতে।
-আমি বিয়ে করবো না। খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল আরাভ। সকলে আরাভের কথায় শকড্। যে ছেলেটা এতদিন শুধু একটু সময় চেয়েছে সে এখন বলছে আমি বিয়ে করবো না।
-কেন করবি না তুই বিয়ে। [আজহার]
-ওকে জোর কেন করছো বাবা। তাছাড়া মহাপুরুষ গন বিয়ে করেন না। আমার ছেলে তো আর মহাপুরুষের থেকে কোন অংশে কম নয়। খাবার খেতে খেতে বললেন আদনান।
-কোন মহাপুরুষ বিয়ে করেনি শুনি। কোমড়ে হাত দিয়ে জিগ্যেস করলেন জুবাইদা
-কেন? আমাদের হিমুই তো বিয়ে করে নি। তাছাড়া,,,
-এই তুমি থামতো। সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুজে থাকতে থাকতে দিন দুনিয়া সব ভুলে গেছো তুমি। বেশ উৎসুক নিয়েই মহা পুরুষদের নাম শুনতে চেয়েছিলো জুবাইদা। কিন্ত প্রথমেই হিমুর নাম শুনে তার মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। আরাভ খাবার ছেড়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে।
পরন্ত বিকাল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এই অসময়ে বৃষ্টির কারন জানা নেই ভূমিকার।এই বৃষ্টিতে একমনে হেটে যাচ্ছে সে। বৃষ্টির পানি শরীরে পড়ে জামাকাপড় শরীরের সাথে লেপ্টে আছে তার। কিন্ত সেদিকে কোন খেয়ালই নেই । ভূমিকার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তার বেশ মন খারাপ। চোখ দু-টো লাল হয়ে আছে। তবে কি সেও এই বৃষ্টির সাথে সাথে কাঁদছে। বৃষ্টিতে ভিজে কাঁদার এই একটাই সুবিধা কোনটা বৃষ্টির পানি আর কোনটা চোখের পানি তা বুঝা যায় না। মেঘের দলের মতো সেও বোঝা সহ্য করতে না পরে চোখে বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে। শুনেছি এক পশলা বৃষ্টির পরে সবসময়ই ভালো কিছু সকলের জন্যে অপেক্ষা করে। তাহলে কি ভূমিকার এই দুঃসময়ের পর সুসময় আসবে। আনমনে হাটছে সে। তখনি খেয়াল করলো কেও তার মাথার উপরে ছাতা ধরেছে। ভূমিকা ছাতার দিকে একপলক তাকিয়ে তার পাশে থাকা লোকটার দিকে তাকালো। লোকটিকে দেখে ভ্রু কুচকালো ভূমিকা অতঃপর বলল,
-আপনি???
#বেলা_শেষে। [১৪]
-আপনি? অস্ফুটভাবে ছুঁড়ে দেওয়া ভূমিকার প্রশ্নে সোজাসাপ্টা জবাব দিলো আরাভ,
-এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন তাই এগিয়ে আসলাম। এনি ওয়ে দিগন্ত কোথায়?? আরাভের কথার একটু হাসলো ভূমিকা যেটা দেখা যায়নি। তবে কেও যাদি খুব যত্নকরে দেখে তাহলে এই হাসিটা দেখতে পারবে। সমানে তাকিয়ে কোন ভাবে জবাব দিলো, ও আসে নি। তারপর চলে যাওয়ার জন্যে সামনে পা বাড়াতেই আরাভ আবার ওর মাথায় ছাতা ধরে।
-ছাতাটা নিয়ে যান। দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
-এসবে আমার অভ্যস আছে। এবার আরাভের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো ভূমিকা । আরাভের দিকে লক্ষ করতেই দেখতে পেলো আরাভ ওর উপরে ছাতা ধরে রেখে নিজেই বৃষ্টিতে ভিজছে। মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর আরাভকে বলল,
-ঠান্ডা আমার নয় আপনার লাগবে মিস্টার আরাভ। ছাতা আমার নয় আপনার দরকার। বলেই বড় বড় পা ফেলে ভূৃমিকা চলে গেলো। আরাভ ছাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো রাস্তার মাঝখানে। তারপর হাটুগেরে বসে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দু-হাত দুদিকে প্রসারিত করে জোড়ে চিৎকার করলো। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় মানুষ জনের কোন সমাগম নেই।আর নেই কোন টাফিক পুলিশ। নাহলে টাফিক পুলিশ এসে আরাভকে তুলে নিয়ে যেত।
ভেজা শরীরে বাসায় ফিরতেই জুবাইদা ব্যস্ত হয়ে পরে ছেলেকে নিয়ে। সাথে গাড়ি থাকতেও তার ছেলে বৃষ্টিতে ভিজছে এটা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কেননা আরাভ খুব একটা বৃষ্টি পছন্দ করে না। যখনি বৃষ্টিতে ভেজে তখনি জ্বর হয়। মোদ্দাকথা বৃষ্টি থেকে সব সময়ই দূরে থাকে আরাভ। আর আজ সেই আরাভ কিনা বৃষ্টিতে ভিজছে। জুবাইদা অনেক বার আরাভকে জিগ্যেস করেছে কেন যে বৃষ্টিতে ভিজছে। প্রতিবারই আরাভ তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে।
জানালার কাচের ওপর আছড়ে পড়া ফোঁটাগুলো আর ল্যাম্পপোস্টের নিচের আলোতে ঝিরঝির করে ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকা বৃষ্টিকণাগুলো নিবিড়ভাবে তাকিয়ে দেখলে এতটাই অপূর্ব লাগে যে, পৃথিবীর কোনো উপমা দিয়ে তার প্রকাশ ঘটানো যাবে না। বৃষ্টি যতই তীব্রতর হতে থাকে অনুভূতির মাত্রা আরও গাঢ় হতে থাকে। অনেক দূরে পেছনে ফেলে আসা ঝাপসা স্মৃতি, তুচ্ছ রাগ শোক অথবা অনেক সুখের কোনো মুহূর্ত যে কারো ভেতরটাকে এতটাই শিহরিত করে যে মনে হয় কেউ একজন তার জীবনের ডায়েরি থেকে প্রতিটা লাইন নির্ভুলভাবে পাঠ করে যাচ্ছেন। নরম চেয়ারে একবার পিঠটা ঠেকিয়ে বসলো ভূমিকা। সেই কখন মেঘলা আকাশের বিষণ্নতা দেখতে—আর সেটা কিনা তাকে নেশার মতো আটকে ধরেছে যেন আর উঠতেই ইচ্ছে হবে না কোনো দিন।
কালের এই ক্ষুদ্র ক্ষণটিকে উপভোগ করা, হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়েও গৌরবময়। অপ্রসন্ন ও প্রশান্তিবিহীন চিত্ত নিয়ে সুদীর্ঘকাল বেঁচে থাকার চেয়ে শুধুমাত্র একটি পরিতৃপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য অস্তিত্বের স্বাদ নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বেশি সৌভাগ্যজনক।
জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ভূমিকা। বৃষ্টিশেষে আকাশে যেমন রংধনু সাত রং নিয়ে হাজির হয়। এক স্বচ্ছ আকাশ। যেখানে মেঘের কোন ছিটেফোঁটা নেই। রৌদ্রউজ্জল আকাশ।ভূমিকার মনটাও আজ তেমনি ফুরফুরে। মনের উপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেছে তার। কাল সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে ভূমিকার জিবনে শুরু হবে এক অধ্যায়। সেখানে দিগন্তের কোন ছায়া থাকবে না। সে জিবনে থাকবে শুধু ভূমিকা আর তার স্বপ্ন। একই ছাদের নিচে থেকেও যদি স্বামি স্ত্রীর মাঝে এক সমুদ্র দুরত্ব থাকে তাহলে সেই সম্পর্কে টেনেটুনে লম্বা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আসলে ভূমিকা আর দিগন্তের একসাথে সংসার। করা হবে না কোনদিনও। আসলে হঠাৎ করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক না। সেদিন যদি একবার মাশহুদ দিগন্তের বিয়ে না করার কারনটা জানতে চাইতো তাহলে আজ ওদের জিবনে এমন দুর্বিষহ নেমে আসতো না। তাই যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার মাতামত নেওয়াটা অত্যন্ত জরুলি।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আরাভ। ঘুম কিছুতেই তার দু-চোখের পাতায় ধরে দিচ্ছে না। ঘুমানোর জন্যে চোখ বন্ধ করলেই ভূমিকার সেই বিষণ্ণ মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর আরাভের বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠছে। ভূমিকার এই বিষন্ন মুখ আরাভ যে কিছুতে সহ্য করতে পারছে না। বারবার কেন ভূুমিকার মুখটা ভেসে উঠছে পর দু-চোখের পাতায়। কিন্তু আরাভ তো চায়না ভূমিকাকে মনে করতে,
-এই অবেলায় কেন এলে আমার শহরে। আমি যে তোমার মায়াজাল থেকে কিছুতেই বের হতে পারছি না। কেন অন্যের প্রিয়তমা হয়ে এলে। আমার ভালোবাসা হীন জিবনে তুমি এলে ঠিকই তবে #বেলা_শেষে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আরাভ। দেয়ালে সাঁটানো ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, রাত বারোটা বাজে বিয়াল্লিশ মিনিট। তার মানে এখনো আদনান ঘুমায়নি। আরাভ কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বসে রইলো। তারপর সে চলে যায় স্টাডি রুমে। কারন আদনান এখনো সেখানে বসে বই পড়ছে।
স্টাডি রুমে আরাভকে দেখে বেশ অবাক হয় আদনান। কারন সে ছাড়া সচরাচর কেও এই রুমে আসে না বললেই চলে। আরাভের যখন বই পড়ার নেশা ধরে তখনি সে আসে এই রুমে।তবে সেটা মাসে এক কি দু-বার। আদনাদ বইয়ের মধ্যেই মুখ গুজে বললেন,
-কি বই লাগবে আমাকে বল, আমি দিচ্ছি।
আরাভ নিঃশব্দে ওর বাবার পাশে বসলো। তারপর শান্ত কন্ঠে আদনানের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
-তোমার কাছে এমন কোন বই আছে কি, যেখানে কোন মানুষ অন্য প্রাণীতে রুপান্তরিত হয়। আরাভের কথায় একটু অবাক হয়নি আদনান। আরাভ বরাবরই সায়েন্স ফিকশন খুব পছন্দ করে। মোহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিটা বই- ই তার পড়া শেষ। আদনানের এখনো মনে আছে। আরাভ যখন স্কাস সিক্স এ পড়ে তখন তিনি আদনানকে বই মেলায় নিয়ে যায়। আর সেখানে সেদিন উপস্থিত থাকে জাফর ইকবাল স্যার। হাজার মানুষের ভীড় ঠেলে আরাভ জারফ ইকবাল স্যারের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-স্যার আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিবেন। আমি আপনার সব বই পড়েছি। একটু খানি বিঞ্জান বই পড়েছি। আরো একটু খানি বিঞ্জান বই ও পড়েছি। এখন আরো, আরো একটু খানি বিঞ্জান বইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছি?? আরাভের কথায় সেদিন লেখক মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো।
-কি হলো আব্বু, বলো আছে এমন বই??
-সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করিস বলে এখন মানুষ থেকে প্রাণীতে রুপান্তরিত হওয়ার বই পড়বি।
-কি করো বলবো তোমাকে, আমি যে মানুষ হয়ে বাঁচতে পাড়ছি না।বুকের বা পাশটায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। এখন যদি একটা পাখি হতাম তাহলে উড়ে চলে যেতাম এক অজানা শহরে। কথাগুলো মনে মনে বলল আরাভ।
আদনাদ একটা বই বের করে আরাভের সামনে দিয়ে বলল, এই নে, নৈঃশব্দ্যের কান্না বই। এটাতে অমিত নামের একটা ছেলে আছে যে মানুষ থেকে গাছে রুপান্তরিত হয়েছে। আরাভ আনমনে বলে ফেলল, আমিও যদি গাছ হয়ে যেতাম। অতঃপর আরাভ বই নিয়ে সেটা পড়তে শুরু করে। বইয়ের যদি পারে ভূমিকাকে ওর মাথা থেকে দূরে সড়াতে।
রাতভর তুমুল বর্ষণের পর সকালবেলা ঝলমলে রোদে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। দিগন্ত ঘুম থেকে উঠে সামনের বারান্দায় গিয়ে বাইরে তাকিয়েই মুগ্ধ হয়ে যায়। সবুজ গাছ-গাছালির ডগায় সকালের কচি সোনা রোদ যেন আহলাদে ঢলে ঢলে পড়ছে। ভাল লাগে দিগন্তের । ইচ্ছে করে অনেকক্ষণ ধরে সবুজের বুকে রোদের হুটোপুটি খেলা দেখতে। সে বারান্দার গ্রীলে মাথা রেখে আনমনে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।
সুখের কোন রং হয় কি-না দিগন্তের জানা নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে দিগন্তের মনে হচ্ছে সময়টা সুখের রং জড়িয়ে ওর সামনে হাজির হয়েছে। দিগন্ত ইচ্ছে করে রঙিন এই সুখকে গায়ে মেখে নিতে। গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বাইরে হাত বাড়ায় দিগন্ত । তারপর সেই হাত আলতো করে মুখে ঘষে। আর তখনি কেও এসে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কিন্ত কে ধরেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি দিগন্তের। এর আগেও যখন দিগন্ত রাগ করতে তখনো তার রাগ ভাঙানোর জন্যে মিমি এইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা রেখে আহ্লাদী সুরে বলল, আমার ভুল হয়েছে। আনাকে মাফ করে দাও প্লিজ। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
মিমিকে পেয়ে দিগন্ত যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। এতটাই খুশি সে। সে মিমিকে সামনে এনে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। বুকের ভেতরের ব্যথাটা এখন ধীরে ধীরে উপশম হচ্ছে। বেশ শান্তি লাগছে এখন তার। মিমি দিগন্তের বুকে মুখ গুজে বলল,
-তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা। জানো যখন শুনলাম তুমি বিবাহিত তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিলো। আমার পুরো পৃথীবি ঘুরতে ছিলো। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার দেখছি সব। ভেবেছিলাম হয়তো মরেই যাব। কিন্তু কাল ভূমি এসে আমাকে সত্যিটা না বললে আমি হয়তো মরেই যেতাম। ভূমিকার কথা শুনতেই দিগন্ত মিমিকে ছাড়িয়ে ওর দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর অবাকের সুরে বলল,
-কি বলেছে ভূমি???
-তোমাদের এই বিয়ের কথা। তোমাকে যে জোড় করে বিয়ে করিয়েছে তোমার বাবা সেটা।
-আর কি বলেছে??
-ভূমি তোমার আর আমার মাঝখান থেকে চলে যাবে। ইন ফ্যাক্ট আজ তো ওর বাসা থেকে চলে যাওয়ার কথা।
-হোয়াট। কোথায় যাবে ভূমি।
-তুমি এত অবাক কেন হচ্ছো দিগন্ত। ভূমি যেখানেই যাক তাতে তোমার কি যায় আসে??
-মিমি, এই শহরে আমি ছাড়া ওর পরিচিত কেও নেই। আমার সাথে এই শহরে এসেছে ভূমি। কোন রাস্তা অলিগলি কিছুই চেনে না সে। যদি কোন বিপদে পড়ে তাহলের তার জবাবদিহি আমাকেই করতে হবে। ভূমিকে ডাকো। ভূমি ভূমি, এই স্টুপিড মেয়েটা কোথায় গেলো। দিগন্তের ডাকে ভূমিকা সাড়া দিলো না তাই দিগন্ত ভূমির রুমে যায়।কিন্তুু সেখানেও দেখতে পায়না ভূমিকাকে। তাহলে কি ভূমিকা চলে গেছে। হয়তো, রুম থেকে ফিরে আসার সময় চোখ পড়ে টেবিলের উপর একটা সাদা কাগজ দোল খাচ্ছে। দিগন্ত গিয়ে সেটা হাতে নেয়। তাতে কিছু লেখা আছে। দিগন্ত সেই লেখাটা পড়তে শুরু করে,
-আমার খোঁজ করবে না। আমি যেখানেই থাকবো ভালো থাকবো। আর হ্যাঁ আপনার যখন মনে হবে এখন ডিভোর্স দরকার, আমাকে ডাকবেন চলে আসবো। অন্যথায় ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবেন।
ভূমিকা চলে যাওয়ায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে দিগন্ত। কোথায় গেলো ভূমিকা। মিমি দিগন্তের এক হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদে মাথা রাখলো। তারপর বলল,
-তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো ওকে নিয়ে। আমার মনে হয়না ভূমিকা কোন বিপদে পড়বে। ভূমিকা খুব স্ট্রোং মেয়ে। না হলে যে সময় সব মেয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্যে আকুতি মিনতি করে। সেই সময় ভূমিকা নিজেকে শক্ত রেখে হাতে লাঠি তুলে নেয়। সব মেয়েদের ই ভূমিকার মতো সাহসী হওয়া দরকার। দিগন্তকে শান্ত করার জন্যে কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে সেও পয় পাচ্ছে, বিপদ কখন কোন দিক থেকে আসে সেটা বলা মুশকিল।
#বেলা_শেষে। [১৫]
আলো- আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালিতে ঝলমল হয়ে উঠে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। এমন রাতে অস্পষ্ট মায়ালোকে নিমজ্জিত থাকে প্রকৃতি। এমন একটি মন মাতানো রাত কার না পছন্দ। সদ্য বিয়ে করা দম্পতি গুলো ব্যাস্ত হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না বিলাসের। ব্যার্থ প্রেমিক বেলকনিতে বসে নিকোটিনের ধোয়া উড়িয়ে মনে করতে থাকে তার সেই প্রিয় মুহূর্তকে। এমন একটি জ্যোৎস্নাময় রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ভূমিকা। গ্রিলের উপর হাত রেখে এই নিস্তব্ধ শহরটার দিকে তাকিয়ে এক মনে ভেবে যাচ্ছে সে। দু-দিন কেটে গেলো অথচ একটা টিউশানির জোগাড় করতে পরে নি সে। বাকি দিনগুলো কি ভাবে কাটাবে সে সেই ভাবনায় ডুবে আছে।
ভূমিকা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নিতুর কাছে চলে আসে। নিতু আর ওর কাজিন পাশের গলিতেই একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। আগে নিতুর কাজিন নয়না একাই থাকতো এখানে। চাকরি সুত্রে এখানে থাকেন তিনি। এখন তিনজনে মিলে থাকছে এই ভাড়া বাড়িতে। মাস শেষে তো বাড়ির ভাড়া মেটাতে হবে। কি করে মেটাবে সেই ভাড়া। এখনো কোন কাজের সন্ধান পেল না ভূমিকা। জানালার গ্রিলটা শক্তকরে চেপে ধরে দু-চোখ বন্ধকরে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার রুমে চলে আসলো। নিতু আর নয়না আপু ঘুমিয়ে গেছে। নিতুর ঘুমানোর স্টাইল দেখে হেসে ফেলল ভূমিকা। এই মেয়েটা এত বড় হয়েছে তবুও কেমন বাচ্চাদের মতো মুখে আঙ্গুল দিয়ে ঘুৃমাচ্ছে। মাথার নিচে বালিশ নাই। অথচ এক পায়ের নিচে পরে আছে বালিশ। আর মাথার নিচে রয়েছে নিতুর হাত। ভূমিকা বালিশটা নিয়ে নিতুর মাথার নিচে দিলো। তারপর ওর মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে গায়ে কাথা দিয়ে দিলো। নিতুর পাশে গিয়ে শুয়ার সময় ভূমিকার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসলো। সে উঠে ফ্রিজ থেকে মিষ্টির বাটি বের করে নিতুর আঙ্গুলে মিষ্টির ঝোল লাগিয়ে দিলো। তারপর ফ্রিজে মিষ্টির বাটি রেখে আবার আগের জায়গায় এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর নিতু আবারও ওর আঙ্গুল মুখে পুরে দিলো। এই দৃশ্যটা দেখে ঠোট চেপে হাসলো ভূমিকা। অতঃপর বলল,
-মিষ্টি আঙ্গুল খাও বোনু। তারপর ভূমিকা কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে।
সপ্তাহ খানেক পড়েই দিগন্তের এক্সাম। পড়াশুনা নিয়ে এখন ভিষন ব্যস্ত সে। কোনদিকে মন দেওয়ার সময় নাই তার। যদিও ভূমিকা চলে যাওয়ার পর ওকে খুজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোথাও খুজে পায়নি সে। এদিকে মাশহুদ কল করে শুধু ভূমিকার কথা জানতে চাইছে। কেননা ভূমিকা তার মোবাইল বন্ধকরে রেখেছে। তাকে কলে পাচ্ছে না মাশহুদ। দিগন্তের একের পর এক বাহানা দিয়ে তার কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাশহুদ সে চিন্তায় তার পেসার হাই করে ফেলেছে। কবে যানি স্ট্রোক করে বসে।
বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছে দিগন্ত। এক্কেবারে বইয়ের ভেতরে মুখ গুজে পড়ছে। এমনি সময় দিগন্তের মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসলো। আজকাল সিম কম্পানি থেকে সারাদিন একের পর এক মেসেজ আসতেই থাকে। তাই সেটাকে পাত্তাদিলো না দিগন্ত। পরো আবারও একটা মেসেজ আসলো। একসাথে দুটো এস এম এস। তাই দিগন্ত মোবাইল হাতে নিলো। পাওয়ার বাটনের চাপ দিতেই মিমির নাম ভেসে উঠলো। দিগন্ত মেসেজটা ভিও করে নিলো।
-মিস্টার হ্যান্ডসাম এখনি আমার বাসার সামনে আসুন। আমি নিচে অপেক্ষা করছি।
এই মেয়েটা আমাকে ফেল করিয়ে ছাড়াবে। বিরক্তি নিয়ে বলে মোবাইল পাশে রেখে দেয়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে আবার মোবাইল হাতে নেয়। মিমিকে বলতে হবে, আমি আসতে পারবো না। না হলে এই পাগলীটা অপেক্ষা করবে। ভাবতে ভাবতে মিমির নাম্বারে ডায়াল করে দিগন্ত। দুর্ভাগ্যবশত মিমির মোবাইল সুইচ অফ দেখাচ্ছে। মোবাইল পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ায় দিগন্ত। মিমি ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধকরে রেখেছে। এটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে । এমন কাজ মিমি মাঝে মাঝেই করে। হঠাৎ করে কল করে বলবে, দেখা করতে। তারপর দিগন্ত যে বলবে সে দেখা করতে পারবে না। একটু ব্যস্ত সেই সুযোগটাও নাই। মিমি মোবাইল বন্ধকরে রেখে দেয়। বাধ্য হয়েই যেতে হয় দিগন্তকে।
মিমির বাড়ির সামনে বাগানে দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত। ঢাকা শহরে সব উচু উচু দালানের মধ্যে মিমিদের বাড়িটা নিত্যান্তই সাধারন। দু-তলা বিশিষ্ট এই বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুরে রয়েছে নানা রকমের গাছ। বিশাল তেতুল গাছের নিচে বসে তেতুল খাচ্ছে মিমি। আর আড় চোখে দিগন্তকে দেখছে। দিগন্ত মন মরা হয়ে দাড়িয়ে আছে। দিগন্তের এমন মুখ দেখে মিমির পচন্ড রাগ হচ্ছে। আসলে দিগন্ত যখন মিমির সাথে দেখা করতে আসে প্রতিবারই একটা করে সাদা গোলাপ নিয়ে আসে। আর সেটা নিজ হাতে মিমির চুলে গুজে দেয়। আজ অনেক রাত, দেকান পাট সব বন্ধ তাই ফুল নিয়ে আসতে পারেনি। আর এজন্যেই মিমির অভিমান হয়েছে। সে দিগন্তের সাথে কথা বলছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে।
দিগন্ত গিয়ে মিমির পাশে বসলো। তারপর একহাত দিয়ে মিমিকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-এত রাতে এভাবে ডাকার কোন মানেই হয় না। সামনে আমার এক্সাম সেটা ভুলে গেছো তুমি। মিমি কোন জবাব দিলো না।
-কি হলো মিমি কিছু বলছো না যে।
-চল না আমরা বিয়ে করে ফেলি। তড়িৎগতিতে ছুড়ে দেওয়া মিমির প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো দিগন্ত। মিমির কাদ থেকে হাত সড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসলো। তারপর বলল,
-কি হলো চুপচাপ হয়ে গেলে কেন? বিয়ে করবে না আমাকে?? [মিমি]
অসহায় মুখ নিয়ে মিমির দিকে তাকালো দিগন্ত। অতঃপর বলল, তোমাকে অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে। তুমি পারবে না মিমি আমার জন্যে লড়াই করতে??
-আমি তোমার কথার মানে বুঝতে পারছি না দিগন্ত।
দিগন্ত মিমিকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো তার বুকের সাথে। অতঃপর বলল,
- তোমাকে বিয়ে করার আগে আমার আর ভূমির ডিভোর্স টা হতে হবে। যেহেতু আমাদের পরিবার থেকে বিয়ে হয়েছিলো তাই ডিভোর্সটা সেখান থেকেই হওয়া দরকার। আব্বা হয়তো জেদ ধরে বসতে পারে তিনি আমাদের ডিভোর্স হতে দিবেন না। তখন কি হবে সত্যিই জানা নেই আমার।
দিগন্তের কথা শুনে মিমি শক্তকরে দিগন্তকে চেপে ধরলে। জড়ানো গলায় বলল, তোমার জানা নেই মানে!! আমি তোমাকে হাড়াতে পারবো না দিগন্ত। তোমার যদি কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় তাহলে আমাকে মেরেফেলে তারপর যাও। আমি তোমাকে কারো পাশে দেখতে পাড়বো না। জানো যখন কারো উপর অধীকার পড়ে যায় না, তখন তার পাশে অন্যকাওকে দেখাকা অনেক যন্ত্রণাদায়ক।
দিগন্ত এবার মিমিকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলো। অতঃপর বলল,
-এই পাগলী কাঁদছ কেন? আমি কোথাও যাচ্ছি না। দিগন্ত তোমার ছিলো, তোমারই থাকবে?? আচ্ছা তোমার কি মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পাড়বো। কখনোও না। এত অপেক্ষার পর তোমার মনে জায়গা করে নিয়েছি। এই দখলদারি আমি কিছুতেই ছাড়বো না।
দিগন্তের এই কথায় হেসে দিলো মিমি।
খন্দকার আজহার মাওদুদ আজ নিজের হাতে কফি করেছে। তার একমাত্র নাতিকে খাওয়াবে বলে কথা। আরাভ ঘুমিয়ে ছিলো তখন আজহার কফির মগ হাতে নিয়ে আরাভের রুমে আসে। জানালার পর্দা খুলে দিলেন আজহার। যার ফলে সূর্যে লাল রশ্নি এসে পড়ছে আরাভের মুখের উপর। আরাভ চোখ মিটমিট করছে। এখনি ঘুমের রেশ কাটিয়ে চোখ মেলে তাকাবে সে। কিন্ত সেটা হলো না, আরাভ মুখের উপর চাদর টেনে উল্টোদিকে ঘুরে শুইলো। আজহার আরাভের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর আরাভকে ডাক দিলেন,
-দাদুভাই,,,,
চট করে চোখ খুলে আরাভ। পিছনের দিকে ঘুরে আজহারকে কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,
-দাদু তুমি কফি হাতে আমার রুমে। সারভেন্টরা সব কোথায়??
আজহার আরাভের পাশে বসলেন। তারপর আরাভকে কফির মগ দিয়ে বললেন,
-তোমার কি হয়েছে দাদুভাই? কেন সারাক্ষণ নিজেকে রুমের ভিতরে আটকিয়ে রাখছো। বৌমা বলল, তুমি নাকি দু-দিন ধরে অফিসে যাচ্ছো না?
আরাভ একটু হাসার চেষ্টা করলো। তারপর মৃদু সূরে বলল,
-আমি ঠিক আছি দাদু। আজ অফিসে যাব। বলেই উঠে দাঁড়ায় আরাভ। আজহার বুঝতে পারছে আরাভ তাদের সকলের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু কি লুকাচ্ছে সেটাই ভাবছে সে।
-দাদু, হোয়াট আর ইউ থিংকিং সো মাচ?
-নাথিং। অতঃপর আজহার চলে যায়। আরাভ ফ্রেশ হয়ে চলে আসে বেলকনিতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো,
-তোমার এমন বদলে যাওয়া পুড়িয়ে মারছে রোজ। রাতের আধার সঙ্গি হলো, চাঁদের হলো দুখ।
বুকের বা পাশে হাত রাখলো আরাভ। তারপর আবার বলল,জানো এই খান টায় খুব যন্ত্রণা হয়। আমি তোমার প্রেমানলে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। ব্যর্থতায় এত কষ্ট এত যন্ত্রণা সেটা আগে জানা ছিল না আমার। না হলে কোন দিন কাওকে ভালোই বাসতাম না। আকাশ পরিমান ভালোবেসেছি আমি তাও সেই ভুল মানুষকে। এতটা ভালোবাসার পরেই আমার ভালোবাসা কোন দিনও পূর্ণতা পাবে না। এর গ্লানি সারাজিবন আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে।
কলেজে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছে ভূমিকা আর নিতু। বেচারি নিতু গাল ফুলিয়ে রেখেছে। রাতে ভূমিকা ওর আঙ্গুলে মিষ্টির ঝোল লাগিয়ে দিয়েছিলো যার কারনে হাতে প্লাস মুখে পিঁপড়ায় কামড়িয়েছে ওকে। নিতু পণ করেছে আর সারাদিনে সে ভূমিকার সাথে কথা বলবে না। এদিকে ভূমিকা নিতুর মুখের ভঙ্গি দেখে ঠোট চেপে হাসছে। এমনি সময় নয়না আসলো ওদের কাছে। আর ভূমিকাকে বলল,
-তোমার টো টিউশানি যোগাড় হলো না। আর হবে কি না সেটাও জানা নেই। বলছি যে, তুমি চাকরি করতে পারো। করবে চাকরি।
নয়নার কথা শুনে ভূমিকা এক চিলতে আশার আলো খুজে পেলো। উৎফুল্ল হয়ে জিগ্যেস করলো, কোথায় চাকরি করবো আপি??
-আমাদের অফিসে। আচ্ছা আমি বসের সাথে কথা বলে দেখবো কেমন। এখন তোমরা কলেজে যাও। আর হ্যাঁ তোমার ওই নাম মাত্র স্বামির সাথে ভুলেও কথা বলবে না। ওই রকম একটা মানুষের জন্যে তোমাকে কষ্ট পাওয়াটা মানায় না। যতটা সম্ভব দূরে থাকবে তার থেকে।
-আমি কষ্ট পাচ্ছি না আপু। উধরে হাসি ফুটিয়ে বলল ভূমিকা।
-না পেলেই ভালো। এখন কলেজে যাও। অতঃপর ভূমিকা মাথা নাড়ালো। সে দিগন্তের সাথে কোন সাক্ষাত করবে না।
ভূমিকা আর নিতু কলেজে যাচ্ছে। হেটেই যাচ্ছে। ওদের বাসা থেকে কলেজ খুব একটা দূরে নয়। নিতু গাল ফুলিয়ে ভূমিকার থেকে দু-কদম এগিয়ে হাটছে। ভূমিকা নিতুর পিছন পিছন যাচ্ছে আর ঠোট চেপে হাসছে। এমনি সময় একটা ছেলে এসে ভূমিকার সামনে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ দিয়ে বলল, ওই ভাইয়াটা আপনাকে দিয়েছে।
ছেলেটার কথা শুনে কপাল কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা।
#বেলা_শেষে। [১৬]
আফনে ফুলগুলো না নিলে ওই ভাইয়ারে টাকা ফিরত দিতে অইবো। ছোট এই বাচ্চা ছেলেটার কথায় ভূমিকা আবারও একই প্রশ্ন করলো। তোমাকে কোন ভাইয়া ফুল দিয়েছে। ছেলেটা তার হাতের ইশারায় ওদের থেকে কিছুটা দূরে একটা দোকান দেখালো। ভূমিকা সে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো কিন্তু সেখানে কাওকেই দেখতে পেল না সে।
-ওখানে তো কেও নেই?? ছেলেটাও সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর বলল,
-কই গেলো ভাইয়াটা!!
নিতু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই পন করেছিল সে আজ ভূমিকার সাথে কথা বলবে না। কিন্তুু তার এই কথা রাখতে পাড়লো না সে। দ্রুত পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। তারপর ছেলেটাকে বলল,
-ফুলগুলো তুমি নিজের কাছেই রেখে দাও। পরে অন্যকারো কাছে বিক্রি করে দিও।
নিতুর কথা শুনে ছেলেটার মন খারাপ করলো। অতঃপর বলল,
-আফনেরা না নিলে আমি ওই ভাইয়াটাকে টাকা ঘুরাইয়া দিমু। ছেলেটার কথা শুনে অবাক হলো ভূমিকা। ছেলেটা ভিষন সৎ। আসলে বচ্চারা সৎ ই হয়। তাদের মন থাকে ফুলের মতো পবিত্র। কমল। পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে উঠে। একটা বাচ্চাকে ছোট থেকে সৎ ভাবে সঠিক শিক্ষায় লালন পালন করলে সেই বাচ্চাটি কখনো অন্যায় পথে পা বাড়াতে পারে না।
ভূমিকা ওর ব্যাগে রাত রাখলো। মাত্র চারশো টাকা আছে। সেখান থেকে একশো টাকা ছেলেটাকে দিলো। আসলে অজানা কারো জিনিস নিতে ইচ্ছুক নয় ভূমিক।। ছেলেটা টাকা নিবে না। অনেক বুঝিয়ে তাকে টাকা দিতে হয়েছে। তারপর ভূমিকা ফুলগুলো নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
দু-দিন অফিসে না আসায় অনেক কাজ জমা পড়ে আছে আরাভের। অফিসে আসার পর থেকেই ফাইলপত্র আর লেপটপে মুখ গুজে আছে সে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো অথচ এখনো এক কাপ কফিও মুখে তুলে নি সে। এদিকে ম্যানেজার সাহেব, লাষ্ট প্রজেক্টের হিসাবে গোলমাল পাকিয়ে রেখেছে। তিনি মাঝে মাঝেই এমনটা করেন। আরাভের ইচ্ছে করে ওনাকে বাদ দিয়ে নতুন ম্যানেজার রাখার। কিন্তু বাবার বন্ধু বলে সেটাও করতে পারে না আরাভের ধারনা তার ম্যানেজার কাকা টুকিয়ে পাশ করেছে। না হলে এত বড় একটা কোম্পানির ম্যানেজার হয়েও সঠিক হিসাব জানে না। ভাগ্যিস সে ম্যানেজার হয়েছিলো, ডক্টর হলে ওটিতেই রোগী মেরে ফেলতো। আর ইন্জিনিয়ার হলে রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে দিতো। এই ম্যানেজার কে নিয়ে দুটানায় পড়ে গেছে আরাভ। তাকে রাখতেও পাড়ছে না। আবার ছাড়াতেও পাড়ছে না।
-স্যার, মে আই কামিং? মেয়েলি কন্ঠ শ্রবণের পর লেপটপে মুখ গুজে রেখেই জবাব দিলো,
-ইয়েস। অতঃপর সে ভিতরে আসলো। আরাভের অপজিট পাশে দাঁড়ালো। আরাভ লেপটপ রেখে তার দিকে তাকালো,
-মিছ নয়না, প্লিজ সিট ডাউন। নয়না তার সিট গ্রহন করলো। তারপর আরাভের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল,
-স্যার আমার কিছু বলার ছিলো।
-প্লিজ সে,,,,
নয়না বুঝতে পারছে না সে কি করে বলবে। এভাবে সরাসরি বসের সাথে কথা বলাটা বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। যদিও আগে অনেক বার বলছে। তখন কাজের ব্যপারে কথা বলছে। এই প্রথমবার সে কাজ ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে কথা বলছে।
-মিছ নয়না, এ্যনি প্রবলেম?
- জ্বি-জ্বি না স্যার। আসলে আমার একটা চাকরি লাগবে।
-হোয়াট???
-আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, সে একটু সমস্যায় পড়েছে। তার জন্যেই বলছি।
-কি ধরনের প্রবলেম??
-স্যার এটা ব্যক্তিগত। তবে চাকরিটা পেলে ওর অনেক সুবিধা হবে।
-ঠিক আছে, কাল ওনাকে আসতে বলুন। কথাটা বলেই আরাভ লেপটপের দিকে তাকালো। নয়না উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো, আমি এখনি ভূমিকে জানিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটা খুব খুশি হবে।
ভূমি নামটা শুনেই আরাভের বুকের ভিতরে ছেদ করে উঠলো। দ্রুত নয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তারপর অস্ফুটভাবে জিগ্যেস করলো,
-কি নাম বললেন আপনি??
-ভূমি, আমাইরা ভূমিকা ওর পুরো নাম।
আরাভের চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে এলো। এতো সেই ভূমি। সেদিন কলেজে ভূমিকা ওকে এই নামটাই বলেছিল। ভূমি চাকরি করবে? কিন্ত কেন?? দিগন্তের মতো একটা স্বামি থাকতে ভূমিকে কেন চাকরি করতে হব? আর ওর কিসের প্রবলেম। নানা প্রশ্ন ঘুড়পাক খাচ্ছে আরাভের মাথায়। হাতদুটো শক্তমুঠি করে দু-চোখ বন্ধকরে নিলো। আরাভের বুকের ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। এখন খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে ভূমিকে।
এক কাপ কফি হাতে মাত্রই বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে দিগন্ত। বিকালের এই সময়টা বেশীরভাগ বেলকনিতে কাটায় সে। ব্যস্ত শহরের মানুষ জনের ছুটেচলা দেখে সে। কফির মগে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে কফির স্বাদ অনুভব করতেই তার ফোন বেজে উঠলো। টাওজারের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো তাতে আব্বা নামটা জ্বলজ্বল করছে। মাশহুদ তালুকদার কল করেছে। এখন কল রিসিভ করলেই ঞ্জানের কথা শুনাবে সে। আর ভূমিকাকে চাইবে। তাই এই মুহূর্তে কল রিসিভ করবে না সে। রিংটোন মিউট করে আবার মোবাইল পকেটে পুরে দিলো। অতঃপর সে কফির স্বাদ গ্রহন করতে লাগলো।
সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না আরাভের। দু-চোখ বন্ধ করলেই ভূমিকার সেই অসহায় কাঁদো মুখটা ভেসে উঠতো ওর চোখে পাতায়। আরাভের মনে হয়, সেদিন বৃষ্টিতে ভূমিকার কাছে না গেলেই হয়তো ভালো করতো।অন্ততপক্ষে তার রাতের ঘুমটা চলে যেত না। শান্তিতে দু- চোখের পাতা এক করতে পারতো।
পরেরদিন সকাল হতে না হতেই অফিসে হাজির হয় আরাভ। এত সকালে আরাভকে অফিসে দেখে সকলে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। সাধারণত আরাভ এগারোটার আগে অফিসে আসে না। আর সেদিন সকাল নয় টায় অফিসে হাজির হয় সে। নিজের কেবিনে বসে অপেক্ষা করতে থাকে কখন ভূমিকা আসবে। আর ওর থেকে সবটা জানবে। দিগন্তের মতো একটা স্বামি থাকতেও কেন তাকে চাকরি করতে হবে!!
এদিকে ভূমিকা লিফট থেকে নামার সময় তার উড়নাটা আটকে যায়। বাহিরে দাঁড়িয়ে উড়না নিয়ে টানাটানি করছে ভূমিকা। একটা সময় উড়না ছুটে যায় আর ভূমিকা কিছুটা পিছিয়ে যায়। পিছিয়ে যায় বললে ভূল হবে আসলো কারো গায়ের উপর পরে যায়। সে ভূমিকাকে ধাক্কাদিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
-এই বেয়াদব মেয়ে, চোখ নাই তোমার?? ভূমিকা লোকটার দিকে ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো। মাধ্যবয়স্ক একটা লোক। মাথার সবগুলা চুলই কালো। স্বাভাকিকের তুলনায় বেশী কালো। ভূমিকার বুঝতে অসুবিধা হলো না লোকটা মাথায় কলপ নিয়েছে। কালো প্যান্ট তার উপরে নীল নীল একটা শার্ট পরিধান করেছে। চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তার। মনে হয় তার উপর ভূমিকা নয় কোন এলিয়েন পরেছে। লোকটা শার্ট ঝাড়া দিতে দিতে বলল,
-দিলে তো আমার শার্টটা নষ্ট করে। কালই বউ আমার শার্টটা ধুয়ে আইরন করে দিয়েছে। চোখ নাই তোমার দেখে হাটতে পারো না। চোখ কপালে নাকি তোমার।
লোকটার কথায় ভূমিকা কেবলাকান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে ওনার শার্ট পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত। আসলে শার্টটা কোথায় নষ্ট হয়েছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভূমিকা ব্যর্থ,। লোকটাকে দেখে কেন জানি ভূমিকার মনে হলো তাকে একটু বিরক্ত করা যাবে। তাই সে বলে উঠলো,
-আমার চোখ তো কপালে। আপনার চোখ কোথায়?? আপনি কি চোখ পকেটে নিয়ে হাটছিলেন??
-আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো তুমি। আমার মুখের উপর কথা বলছো। তুমি জানো আমি কে??
-এমা, আপনি জানেন না কে আপনি?? ওকে আমি এখনি সোসাইল মিডিয়ায় আপনার একটা ছবি আপলোড করে দিচ্ছি। কেও যদি আমাকে চিনে থাকে তাহলে সে আপনার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করবে। মোবাইল বের করে মুখ টিপে হেসে বলল ভূমিকা।
-এই মেয়ে এই মেয়ে তুমি কিন্ত বেশী বকছো। ভূমিকা এবার দু-ঠোট প্রসারিত করে হেসে দিলো। আর লোকটা তার শার্ট ঠিক করতে ব্যাস্ত। তখনি পিছন থেকে কেও বলে উঠলো,
-ম্যানেজার কাকা আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?
পুরুষনালী কন্ঠশ্বর শুনে ম্যানেজার পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ভূমিকার সেই লোকটার দিকে দৃষ্টি দিলো। লম্বা শ্যামবর্ণের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা পকেটে হাতগুজে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে আছে। পড়নে কালো প্যান্ট, নীল শার্টের উপর কালো টাই ঝুলানো। ভূমিকা বুঝতে পারছে সবাই কেন নীল শার্ট পরে আছে। যাগগে বাধ দেই সে সব কথা। ওটা ভূমিকার চিন্তার বিষয় না। আজ তার একটা চাকরি পেলেই হলো।
-ম্যানেজার কাকা এখনো এখনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছে। যান, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করুন। নাহলে আজ কিন্তু আপনার ছুটি হবে না। আর বাড়ি ফিরে বউয়ের হাতে রান্না করা খাবারও খেতে পাড়বেন না । ছেলেটার কথায় ম্যানেজার বিরক্তি মুখ করে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-সব হয়েছে এই মেয়েটার জন্যে। আমি তোমাকে পরে দেখে নিবো।আগে কাজ শেষ করে আসি। কোন রকমে কথাগুলো বলে একপ্রকার দৌড়ে সে চলে গেলো সে। ম্যানেজার চলে যেতেই ছেলেটা বিকট শব্দে হেসে উঠলো। ভূমিকাও হাসলো তবে সেটা সামান্য। ম্যানেজার যে বউ পাগলা এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।
-বাই দ্যা ওয়ে। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। নতুন নাকি?? ছেলেটার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে ভূমিকা নিজেকে কিছুটা সংযত করে বলল,
-আসলে আমি আজই প্রথম এলাম। চাকরি খুজে।
-ওও আচ্ছা, আপনি তাহলে সেই। আসুন। স্যার আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছে। অতঃপর ভূমিকা সেই ছেলের পিছুপিছু আরাভের রুমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।