গল্পঃ সুখপাখি
পর্বঃ (২ ও শেষ )
শশুরমশাই এইবার আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ থেকে জল পড়ছে। আমাকে বললেন, কি হয়েছে বৌমা? কাঁদছো কেন? আর এইভাবে বেয়াই বা চলে যাচ্ছে কেন? আরে বাবা দুইজনেই চুপ করে আছো কেন? কেউ তো কিছু বলো।
বাবা এইবার বেশ কঠিন গলায় বলে, কি বলবো বেয়াই? আমি তো কিছু বলারই ভাষা পাচ্ছি না। চার বছর হলো আমার মেয়ে আপনার ছেলের বউ আর আমার মেয়ে আপনার ছেলের পকেটে হাত দিয়েছে জন্য আপনার বউ আমার মেয়েকে চোর অপবাদ দিয়েছে। শুধু চোর অপবাদ নয় যা মুখে আসছে তাই বলছে আর আপনার ছেলে সে উল্টে আমার মেয়েরই দোষ ধরছে কেন সে তার পকেটে হাত দিয়েছে। আচ্ছা স্বামী - স্ত্রীর মাঝে যদি এতটুকু বিশ্বাস না থাকে তবে সে সম্পর্কের কি কোনো মূল্য আছে? আমার স্ত্রী শুধু আমার পকেটে হাত দিবে কেন সে পকেট থেকে টাকাও নিবে তার দরকারে এই সামন্য বিষয় নিয়ে এত কথা কেন হবে? এইসব নিজেদের পার্সোনাল কথা আমার মা-বাবাই বা কেন জানবে?দেখুন বেয়াই এইসব দেখে আমি আমার মেয়েকে কোনোভাবেই এইখানে রেখে যাবো না৷ আমরা মধ্যবৃত্ত পরিবার কিন্তুু আমাদের আত্মসম্মান কম নেই৷
বাবার কথা শেষ হতেই পেছন থেকে সাফোয়ান বলে, তাই নাকি? আপনাদের আত্মসম্মান খুব বেশি। তা মেয়েকে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে গেলে সেই আত্মসম্মান টিকবে তো?
সাফোয়ানের কথা শুনে শশুরমশাই বললেন, চুপ করো সাফোয়ান। কি হচ্ছে টা কি! উনি তোমার শশুর উনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলো। আর বেয়াই আপনি প্লিজ শান্ত হোন ভেতরে আসুন। আমরা বসে সব কথা বলি। নিরা মা তোমার বাবাকে বোঝাও।
বাবা কিছু বলবে তার আগেই সাফোয়ান বলে, না বাবা উনাকে এত তেল দেওয়ার কিছু নেই৷ উনি উনার মেয়েকে নিয়ে যাবেন ভালো। দেখি না কদিন রাখতে পারে৷ আর নিরা খুব তো বাবার কথা শুনে চলে যাচ্ছো পরে কিন্তুু পস্তাতে হবে।
সাফোয়ানের কথায় বাবা আরো রেগে গেলেন প্রচন্ড রাগ নিয়ে বললেন, আত্মসম্মান মানে কি সেটা তো তুমি বুঝো না সাফোয়ান। বুঝার দরকার ও নাই। তুমি তোমার মতো চলো। আর বিশ্বাস করো আমার মেয়ে আমার কাছে একবিন্দু পরিমাণ ও বোঝা নয়। তাই আমার কাছে নিরা ভালোই থাকবে। আর বেয়াই আপনার ছেলের কথা তো শুনলেন আশাকরি এরপর আমাকে আর কিছু বলতে হবে না। আসি আমরা।
শশুরমশাই আর কিছু বলার আগেই বাবা আমাকে নিয়ে চলে আসলো। গাড়িতে উঠে বাবার কঠিন মুখ কেমন ভার হয়ে গেলো। বুঝতে পারছি ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পেয়েছে। আসলে কোনো বাবাই চায় না তার মেয়ের সংসার ভাঙতে। আমিও নিজেকে শক্ত করলাম এখন যদি আমি ভেঙে পড়ি তো বাবা নিজেকে সামলাতে পাড়বে না।
ঘন্টাখানেক পর আমার বাড়িতে পৌছালাম। মা আমাকে বাবার সাথে দেখে অবাক হয়ে বললেন, একি নিরার বাবা তুমি মেয়ে জামাইকে শিতের পিঠা খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত দিতে গেলে? কিন্তুু মেয়েকে নিয়ে চলে আসলে যে?
বাবা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলো। মা আমাদের চেহারা দেখে বুঝলেন কিছু হয়েছে। মা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন কি হয়েছে। আমি ও আর শান্ত থাকতে পারলাম না। মাকে জড়িয়ে ধরে কেদেঁ উঠলাম। আমার কান্নার শব্দ শুনে বাবা ভেতরে আসলেন তারপর বললেন, নিরা তুই কাদঁছিস কেন? তুই কি ভাবছিস তোর বাবা ভুল করেছে তোকে এনে?তুই যদি এটা মনে করিস তাহলে তোকে ওই বাড়িতে আমি রেখে আসবো যেভাবেই হোক। দরকার পড়লে সাফোয়ানের পা ধরবো।
আমি বাবাকে বললাম, না বাবা তুমি কোনো ভুল করো নি। আমি তো গর্ববোধ করছি যে তুমি আমার বাবা। কজন বাবা পারে মেয়ের অপমানের জবাব এইভাবে দিতে। অন্য কেউ হলে সমাজের ভয় করে আমাকে ওইভাবেই ওইখানে রেখে আসতো। চার বছর ধরে ওর সকল অন্যায় মেনে নিয়েছি। ওর কথায় কথায় আমার গায়ে হাত দেওয়া৷ আমার মা - বাবা তুলে গালাগাল দেওয়া সব সহ্য করেছি যে একসময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কিন্তুু না আসলে ও বদলানোর মানুষই না। তাই যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে বাবা। সত্যি আমি অনেক ভাগ্যবতী যে তোমার মতো বাবা পেয়েছি।
মা আমার কথা শুনে আবারো জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে?
বাবা সবটা খুলে বললেন। মা ও বাবার সাথে একমত হলেন। মা আমাকে বললেন, চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। সাফোয়ান নিজের ভুল বুঝতে পারলে ঠিক তোমাকে নিয়ে যাবে।
মা অনেক কথা বললেও আমি তো সাফোয়ান কে চিনি। আমি জানি ও কখনো বদলানোর ছেলে নয়। আমাকে ছেড়ে দিবে কিন্তুু কখনো নিজের ভুল ধরবে না।
তবুও নিজেকে শক্ত করলাম। যা আছে কপালে তাই হবে৷
এরপর কেটে গেলো পনেরো দিন। সাফোয়ান বা ওর পরিবার কোনোরকম যোগাযোগ আমার সাথে করে নি। পনেরোদিন পর সাফোয়ান ফোন করলো। আমি ভাবলাম হয়তো ওর ভুল বুঝতে পেরে ফোন করেছে তাই খুশি হয়ে ফোন রিসিভ করলাম কিন্তুু ফোন রিসিভ করতেই সাফোয়ান বললো, কিরে তোর তো অনেক জেদ দেখছি৷ চারবছরে সবসময় আমার কথা মতো চলতি আর আজকে বাবা একটু সাথ দিতেই তোর অনেক তেজ হইছে। ভালো তেজ দেখায় থাক। তোর মতো দশটা মা/গী সাফোয়ান মিনিটে পাবে বুঝছিস। শোন কোর্টে আমাদের ডিভোর্স ফাইল করছি কালকে নোটিশ চলে যাবে চুপচাপ সই করে দিস। আর শুন যদি আমার কাছে ফিরতে চাস তো শেষ সুযোগ আজকের মধ্যে তোর বাবা যেন তোরে এখানে রেখে যায় আর আমার মা-বাবার পা দরে মাফ চায়।
কথা শেষ করেই কল কেটে দেয়। ওর কথা শুনে এইবার আমার কেন যেন কান্না আসে না।ঘৃণায় বমি আসে। বাবাকে সবটা জানাই। বাবা বলে তুমি কি চাও? তুমি যা চাও তাই হবে।
আমি বলি বাবা আমি অনার্সে আবার ভর্তি হতে চাই। বাবা বলে, ঠিক আছে।
পরেরদিন কোর্ট থেকে নোটিশ আসে। আমি সই করে দিই। কোর্টে কেস উঠে। কোর্ট থেকে ছয়মাস সময় দেওয়া হয়।
আমি আবারো অনার্সে ভর্তি হই। এরমধ্যে এনআরটিসি থেকে সার্কুলার ছাড়ে। আমি জুনিয়র শিক্ষক পদে আবেদন করি। এরপর মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। এর মধ্যে সাফোয়ান মাঝে মাঝে ফোন করে গালি গালাজ পারতো তখন আমি ওর নাম্বার ব্লক করে দিতাম। এইভাবে ছয়মাস কেটে যায়৷
আমার আর সাফোয়ানের ডিভোর্স টা হয়ে যায়। সমাজের মানুষ নানা কথা বলে কিন্তুু মা -বাবার প্রচুর সাপোর্ট পাওয়ায় আমি সবটা ভুলতে পারি। এরপর জুনিয়র শিক্ষক পদে আমি প্রিলি দেই। প্রিলির রেজাল্ট বের হয় আমি টিকে যাই তারপর লিখিত পরিক্ষার জন্য প্রস্তুুতি নিতে থাকি।
এরমধ্যে খবর পাই সাফোয়ান বিয়ে করছে ধুমধাম করে। নিজেকে যতই শক্ত করি না কেন মনের মধ্যে কোথাও একটা সাফোয়ান রয়েই গেছিলো তাই বুকের মধ্যে কেমন করলো। তবুও নিজেতে শক্ত রাখলাম। পড়াশুনায় আরো মনোযোগী হলাম। এরপর অনার্স পরিক্ষা দিলাম। সেইখানে ফাস্ট ক্লাস পেলাম। এর কিছুদিনপর রিটেন এক্সাম দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ টিকে গেলাম। এরপর ভাইবা দিয়ে ও টিকে গেলাম। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরিক্ষার পর আমার চুড়ান্ত সুপারিস হলো। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমার নিয়োগ হলো। বাড়ি থেকে যাতায়াত করা কষ্ট হতো তাই ওইখানেই বাসা ভাড়া করে থাকতাম। এরমধ্যে খবর পেলাম নারী নির্যাতনের মামলায় সাফোয়ান ও তার মাকে তার নতুন বউ পুলিশে দিয়েছে। বিয়ের পর থেকে তারা বউয়ের উপর অত্যাচার করতো। মনেমনে কেমন যেন খুশি লাগলো। বুঝলাম পাপের শাস্তি ঠিকই পেতে হয়।
দিন যেতে থাকে চাকরির পাশাপাশি আমি অনার্স কমপ্লিট করি। তারপর মাস্টার্সে ভর্তি হই। তারপর মাস্টার্স কমপ্লিট করে প্রাইমারিতে পরিক্ষা দিই। প্রথমবারই টিকে যাই। তারপর এই জবটা ছেড়ে প্রাইমারিতে জয়েন করি। এরমধ্যে খবর পাই সাফোয়ান জেল থেকে এসে আবারো বিয়ে করেছিল বউ নাকি সব টাকা পয়সা গয়না নিয়ে অন্য লোকের সাথে পালিয়েছে। বেচারা এখন বিয়ে করার জন্য কোনো মেয়ে ও পাচ্ছে না।
এইদিকে প্রাইমারিতে জয়েন করার পর থেকে মা-বাবা খুব করে লেগেছে বিয়ে করার জন্য। আবার আমারো মনে হচ্ছে এইবার জীবনটা গোছানো দরকার। তাই বাবা -মাকে হ্যা বলি। মা -বাবা বলে আমার আগের মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আতিকুর রহমান বিয়ের প্রস্তাব অনেকদিন ধরেই দিচ্ছে। লোকটাকে আমি অনেকবছর ধরেই চিনি। খুব ভালো মানুষ। বাচ্চা হতে গিয়ে বউ মা/রা গেছে। ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। আমি সম্মতি জানালাম৷ কিছুদিন পরই খুবই সাধারণ ভাবে আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পরে আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসারে সবকিছু নিয়ে ভালোই ছিলাম৷ মেয়ের নাম নিকিতা। আমাকে খুবই ভালোবাসে। সারাদিন আম্মু করে ডাকতে থাকে। সংসার চাকরি সবকিছু নিয়ে ভালোই ছিলাম।এরইমধ্যে স্কুলে যাওয়ার সময় একদিন পেছন থেকে সাফোয়ান আমাকে ডাক দিলো৷ আমি কথা বলতে চাইলাম না তাই চলে যেতে লাগলাম কিন্তুু সাফোয়ান বললো, নিরা একবার আমার কথা শুনো শেষবারের মতো।
আমি দাঁড়ালাম তারপর বললাম, কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন। আমার সময় কম।
সাফোয়ান বললো, আমাকে ক্ষমা করে দিও নিরা। আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তার শাস্তি ও অবশ্য আমি পাচ্ছি। তুমি আমার জীবন থেকে চলে আসার পর ভেবেছিলাম আমার কিছু হবে না। কিন্তুু আমি শেষ হয়ে গেছি। তোমার মতো কেউ আসে নি। তোমার মতো কেউ সহ্য করে নি।কেউ শাস্তি দিয়েছে কেউ ছেড়ে গেছে। আর একসময় আমি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরি৷ এরপর কিছুদিন হলো এইচআইভি পজেটিভ ধরা পড়েছে। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাই তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসলাম। তুমি ক্ষমা না করলে আমি ম/রেও শান্তি পাবো না।
সাফোয়ানের কথা শুনে আমার কোনো ফিলিংস জাগলো না। শুধু বললাম, আসোলে কি তোমরা ছেলেরা মেয়েদের বাড়িতে বউ করে নিয়ে যাওয়ার পর ভাবো কাজের লোক এনেছো। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে তোমাদের সেবা করবে আবার একটু এমন তেমন হলেই কথা শুনাবে। গায়ে হাত তুলবে৷ আর এটা তোমাদের মৌলিক অধিকার। তোমরা ভাবো একটা ডিভোর্স হলে শুধু মেয়েদের মর্যাদা কমে তোমরা ছেলেরা তো ধোয়া তুলসি পাতা। গোসল করলেই সব শেষ। কিন্তুু জানো কি উপরে একজন আছে তিনি ঠিকই সবার বিচার করেন। হয়তো কারো আগে আবার কারো দুইদিন পরে। কিন্তুু বিশ্বাস করো তোমার উপর আমার বিন্দুু পরিমান রাগ ও নেই। তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না দিতে তাহলে আমি আমার স্বামীর মতো মানুষকে জীবনে কখনো পেতাম না আর না নিজের পায়ে দাড়াতে পারতাম। তাই আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই মিস্টার সাফোয়ান। ভালো থাকবেন।
সাফোয়াকে কথাগুলো বলেই পেছন ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। মনের মধ্যো অদ্ভুত এক প্রসান্তি অনুভূত হচ্ছে। আসলে ছেলে হোক বা মেয়ে কাউকে কষ্ট দিয়ে অবহেলা করে কেউ সুখি হতে পারে না কারণ সুখপাখি তো ওই আল্লাহর তৈরি। আর অন্যকে কষ্ট দেওয়া ব্যাক্তিকে আল্লাহ কখনোই পছন্দ করেন না।
~ সমাপ্ত ~