বেলা শেষে: শেষ পর্ব

 


#বেলা_শেষে। [২৭]


আরাভের বাবা আর দাদু মিলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভূমিকার গ্রামের বাড়ি যাবে।আরাভ আর ভূমিকার বিয়ের ব্যপারে তারা ভূমিকার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে। ওনারা রাজি হলে ভূমিকা কিছুতেই অমত করতে পারবে না। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দুদিন পরে আজহার মাওদুদ তার ছেলে ওর নাতিকে নিয়ে রওনা দেয় ভূমিকার গ্রামের উদ্দেশ্যে। আরাভের শহর ছেড়ে যাওয়ার কথা মাহিনের কান পর্যন্ত পৌছাতে সময় লাগে না । আসলে মাহিন ভূমিকা আর আরাভের পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলো। কে কখন কোথায় যায় সেটারই খবর নেওয়ার জন্যে। সে দিন আরাভ গ্রামে চলে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যে খবর পৌছায় মাহিনের কানে। মাহিন ও কম কিসে সে তখন থেকে প্রস্তুুত থাকে ভূমিকার ক্ষতি করার। কিন্ত মাহিনের দুর্ভাগ্য সেদিন ভূমিকা বাসা থেকেই বের হয়নি। কারন সেদিন নয়না আর আর রাকিব এসেছিল ভূমিকাদের বাসায়। পরে অবশ্য সবাই জানতে পেরেছিলো আরাভ গ্রামে যাওয়ার আগে রাকিবকে ওদের বাসায় যেতে বলেছিলো। মাহিনের শকুনের মতো চোখ সে যখন তখন হামলা করতে পারে ভূমিকার উপর।


ভূমিকার বাবা মা দুজনেই আরাভের সাথে ভূমিকার বিয়ে কথা শুনে খুশি হয়। তারা তো আরাভকে আগে থেকেই চিনে। আরাভ ভূমিকাকে বিয়ে করবে শুনে তারা খুব খুশি হয়। তারপর তারা গ্রামের চেয়ারম্যান মাশহুদ তালুকদারের বাড়ি যায়। মাশহুদ তালুকদার কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। ছেলের উপর অভিমান করে কিছু জানায়ও নি তাকে। মাশহুদের স্ত্রী দিগন্তকে এ ব্যপারে জানাতে চাইলে মাশহুদ তাকেও মানা করে দেয়। মাশহুদ চায়না দিগন্ত গ্রামে আসুক।


গ্রাম থেকে ফিরে আসার দুই সপ্তাহ পরে ভূমিকার সাথে আরাভের বিয়ে সম্পন্ন হয়। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হয়েছিলো তাদের। ততদিনে মাহিন ওদের কোন ক্ষতিই করতে পারেনি। আর তাদের দুজনের ভালোবাসার ফল হলি তুই। আরাভ আর ভূমিকার একমাত্র ছেলে খন্দকার জুবায়ের আহসান অভি।


জুবাইদার কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করলো অভি। তারপর বলল,


-আমার আম্মু নাম তো ভূমি। ভূমিকা না। আর ভূমিকা আইনজীবি পড়ছিলো কিন্তু আমার আম্মু তো হসপিটালে থাকে।


জুবাইদা অভির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ থাকে। কারন নার্সিং হোমই এখন তোর আম্মুর ঘর। নে এবার ঘুমিয়ে পরতো দেখি। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে তো নাকি। স্কুলে যাওয়ার নিয়ত আছে না নাই। জুবাইদার কথার প্রতিউত্তরে প্রথমে মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো অভি। তারপর আবার হ্যাঁ সুচক জবাব দিলো। বালিশে মাথা রেখে দু-চোখ বন্ধকরে কোমল সুরে বলল,


-দাদু কাল আম্মু আসবে তাইনা। অভির করা প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলো না জুবাইদা। কাল অভির স্কুলে প্যারেন্স কল করেছে। ভূমি আসবে তো। 


হসপিটালে সাধারণত কখন রাত হয় আর কখন দিন হয় তা বুঝা মুশকিল। এখানে রাত আর দিন দুটোই এক মনে হয়। পার্থক্য শুধু ঘড়ি দেখায়। ঘড়ির দিকে তাকালেই বুঝা যায় এখন দিন নাকি রাত। কেবিনের ভেতরে বেডের উপর শুয়ে আছে আরাভ। মুখে অক্সিজেন মাক্স হাতে সেলাইন লাগানো। তার পাশেই আরাভের একটা হাত ধরে বসে আছে ভূমি। চোখের কোনে অশ্রুর ভীড় তার। ঠোট চেপে কান্না আটকিয়ে রেখেছে সে। কতরাত কত দিন যে এভবে বসে থেকে পার করেছে তার হিসাব নেই। দু বছর ধরে এই নার্সিংরুমকে নিজের বাসা বানিয়ে নিয়েছে ভূমি। শুধু একটা আশায় কখন আরাভ জেগে উঠবে আর বউ বলে ওকে সম্বোধন করবে। ভূমির চোখের কোটর গড়িয়ে দু ফোটা পানি পড়লো। অতঃপর সে বলতে লাগলো,


-আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি খুব শান্তি পাও তাই না আরাভ। দেখে আরাভ আমি কাঁদছি তোমার কষ্ট হচ্ছে না। তুমিই তো বলেছিলে, তোমার চোখের পানি দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়, আমি তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। দেখো আরাভ আমি কাঁদছি। এখন কষ্ট হচ্ছে না তোমার। একবার আখি খুলো আরাভ। জানো আরাভ আমাদের ছেলেটা আজ কত বড় হয়েছে। ও বাবা বলে ডাকতে পারে। ওর সাথে যখনই দেখা করতে যাই। প্রতিবার শুধু একটা কথাই বলে, আমার পাপা কোথায়? তুমি তো বলেছিলে পরের বাবা পাপাকে নিয়ে আসবে তাহলে কি পাপা আসে নি। অভির কথার জবাব দিতে পারি না আমি। ছেলেটাকে একটা মিথ্যের মধ্যে আটকিয়ে রেখেছি। জানো আরাভ আমি মাহিনকে শাস্তি দিয়েছি। মাহিনের পাপে শাস্তি পেয়েছে সে। আমি নিজে কোর্টে ওর প্রতিপক্ষ লো ইয়ার হিসাবে লড়েছি। একজন আইনজীবি না হয়েও মাহিনকে তার প্রাপ্যা শাস্তি দিয়েছি।তুমি খুশি হওনি আরাভ। কবে জাগবে তুমি আরাভ। আমি যে আর পারছিনা। তোমাকেএই অবস্থায় মেনে নিতে পারছিনা আমি। দু দুটো বছর ধরে বেচে থেকেও মৃত মানুষের মতো বেচে আছো। আর কত কাঁদাবে আমাকে। রোজ রোজ তো একটা আশায়ই থাকি তুমি চোখ মেলে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখবে। আমাকে আবার কাছে টেনে নিবে। আচ্ছা তোমার সেই দিনের কথা মনে আছে। আমাদের বিয়ের দিনের কথা। কি বোকাটাই না বানাইছিলে তুমি আমাকে। আর আমিও কি সুন্দর তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তোমার করা দুষ্টুমি গুলো আমাকে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা দেয়। সেটা তুমি বুঝতে পারো না। তুমি কবে ফিরবে আরাভ। বিয়ের পর তিনটা বছর ছিলো আমার জিবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন সময়। সেই সময়ের মতো বাকিটা জিবন কাটাতে চাই আমি। আর তার জন্যে তোমাকে প্রয়োজন আরাভ। প্লিজ কাম ব্যাক। আরাভের হাতদুটো দিয়ে ধৃষ্টতায় স্পর্শ করে ভূমি।ভূমির অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আরাভের হাতের উপর। এটা আজ নয় বরং দু বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে।


পরের দিন খন্দকার জুবাইদা আর খন্দকার আদনাদ দুজনে মিলে অভিকে নিয়ে স্কুলে যায়। প্রি- ক্যাডেট স্কুলের নার্সারির স্টুডেন্ট অভি। পড়ালেখায় বাবা মায়ের মতোই ব্রিলিয়ান্ট হয়েছে অভি। খন্দকার আদনান মাহবুব ওদের স্কুলে পৌছে দিয়ে সে কলেজে চলে যায়। খন্দকার জুবাইদা তার একমাত্র নাতিকে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ভূমির জন্যে।


কিছুক্ষণ পর গোলাপি থ্রি-পিছ পরিহিত একটা রমনী প্রবেশ করে স্কুলের ভিতরে। মাথায় তার সাদা হিজাব আর হাতে একটা পার্স। চোখের নিচে কালচে দাগ পরে আছে। ঠোটগুলো কেমন ড্রাই হয়ে আছে। রমনীকে আসতে দেখে অভি অস্ফুটভাবে বলে উঠলো,


-আম্মু। অভির কনা শুনে পাশে তাকায় খন্দকার জুবাইদা। সামনে ভূমিকে দেখে তার অধরে হাসি ফুটে উঠে। ভূমি এসেছে তাহলে। ভূমি ওদের কাছে এসে অভিকে কোলে তুলে নিয়ে অভির পুরো মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিলো। ছেলেকে কাছে পেয়ে আনন্দ অশ্রুতে তার চোখ ভরে উঠেছে। অভি তার মাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,


-পাপা আজও আসেনি তাইনা মাম্মা। অভির কথার এবারও কোন জবাব দিল না ভূমি। মৌনতা অবলম্বন করলো সে।


শ্বাশুড়ি আর ছেলেকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায় ভূমি। লাঞ্চ করে হসপিটালে ফিরে যাবে সে। ভূমি নিজে হাতে অভিকে খাইয়ে দিচ্ছে আর খন্দকার জুবাইদা তাকিয়ে আছে তার ছেলের বৌ আর নাতির দিকে।


-এভাবে কি দেখছো মা?? অভিকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল ভূমি।


-আমার বাড়িটা বড্ড ফাঁকা। বাড়ি ফিরে চল।


-তোমার ছেলেকে না নিয়ে আমি ফিরবো না মা। আরাভকে সাথে নিয়ে তবেই ফিরবো।


-এই বলে বলে তো দুই বছর কাটিয়ে দিলি। আমাদের কথা বাদ দিলাম এই ছোট অভির কথা একবার ভেবে দেখেছিস। বাবা মাকে ছাড়া ওর থাকতে কতটা কষ্ট হয়।


-আমি তো অভিকে আমার সাথেই রাখতে চাই। তোমারাই ওকে রেখে দিচ্ছো।


-এভাবে আর কত লড়াই করবি নিজের সাথে। আরাভের ফিরবে সেই আশা আমি বাদ দিয়ে দিয়েছি। তোকে আর অভিকে নিয়েই তো এখন আমাদের সব আশা। ফিরে আয়।আমার বাড়িটাকে আবার ভরিয়ে তুল।


-নিজের সাথে লড়াই করে তো এতদিন কাটিয়ে দিলাম। মাঝপথে এসে পা পিছলে পরে যাব। না মা। এটা হতে পারে না। আমি আরাভকে,,, মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো ভূমিকার। অভিকে মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে কল রিসিভ করলো ভূমিকা। ওপাশ থেকে কি বলল সেটা জানা নেই। ভূমিকা অভিকে তার শ্বাশুড়ির কোলে বসিয়ে দিয়ে বলল,


-আমাকে যেতে হবে মা। তুমি অভিকে নিয়ে সাবধানে যেও ঠিক আছে।


-কোথায় যাচ্ছিস??


-এখন যাচ্ছি, পরে তোমাকে সবটা বলল কেমন। জুবাইদাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। চলে যায় ভূমি।


ইন হসপিটাল,


কেবিনের সামনে এসে থ মেরে দাঁড়িয়ে যায় ভূমি। ভেতর থেকে অনেক মানুষের আওয়াজ আসছে। তার মধ্যে দুজনের গলার আওয়াজ তার চেনা। বাকিগুলো কে?? ধীর পায়ে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে সে। ভেতরে ডুকতেই স্তব্ধ হয়ে যায় সে।


#বেলা_শেষে। [বোনাস পার্ট]


ভূমিকে কেবিনের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা নার্স বলে উঠে,ওইতো মিসেস আরাভ। কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার স্বামীর ঞ্জান ফিরেছে। নার্সের কথা ভূমিকার কান পর্যন্ত পৌঁছালো কিনা সেটা বুঝা গেল না। ভূমিকার কোন রিয়্যাকশন ই হলো না। ভূমি কোন কথাই বলছে না। অপলক তাকিয়ে আছে বেডের এক সাইডে বসে থাকা আরাভের মুখের দিকে। আরাভ ও তাকিয়ে আছে তার প্রিয়সির দিকে। ঠিক কতদিন পরে সে তার প্রিয়সির মুখটা দেখতে পেয়েছে। সেটা জানা নাই তার। ডক্টর এবং নার্সরা আরাভ আর ভূমির অবস্থা বুঝতে পারছে।সবাই ওদের স্পেসস দিয়ে এক এক করে প্রস্থান করে। সবার চলে যাওয়ার পর ভূমি ধীর পায়ে আরাভের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ততক্ষণে আরাভও বেড থেকে উঠে দাঁড়ায়। এতদিন পর ঞ্জান ফিরে আরাভের কোন রিয়্যাকশন - বুঝা যাচ্ছে। সে শুধু তাকিয়ে তার প্রিয়সির মুখের দিকে। ভূমি তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কি আরাভ ভালো হয়েছে। চোখের দেখাকে সত্যি প্রমাণিত করার জন্যে সে আরাভের মুখে হাত বুলাতে থাকে। হ্যাঁ সত্যিই তো আরাভ সুস্থ হয়ে গেছে। আরাভের গালে হাত রাখতেই আরাভ ভূমির হাত ধরে ফেলে। হাতের উল্টোদিকে আলতো করে চুমু খেয়ে অস্ফুটভাবে বলে,


-আমার ভূমি। তারপর ভূমির দু গালে হাত রাতে আরাভ। অতঃপর বলে, তুমি ঠিক আছো ভূমি। মাহিন তোমার ক্ষতি করেনি তো। ভূমি মৃদু হাসে তারপর আরাভের হাতের উপর হাত রেখে বলে,


-আমার কিচ্ছু হয়নি আরাভ। আমি একদম ঠিক আছি।এবার কেঁদেই দেয় ভূমি। সাথে সাথে আরাভ ভূমিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ভূমিকাও আরাভকে দু হাতে শক্তকরে চেপে ধরে। এতদিন ধরে জ্বলতে থাকা মনের আগুনটা আজ একটু প্রশমিত হলে বলে। 


খন্দকার বাড়িতে আজ খুশির আমেজ। পুরো বাড়ি উল্লাসে মাতোয়ারা। দুই বছর পর তার ছেলে আর ছেলের বউ বাড়ি ফিরছে বলে কথা। অভি তো দুপুর থেকে ড্রয়িংরুমেই বসে আছে। আজ তার পাপা আসবে। খন্দকার জুবাইদা শত বুঝিয়েও ওকে ভিতরে নিয়ে যেতে পারে নি। ড্রয়িংরুমে বসে মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সে। কখন সে তার পাপাকে দেখতে পাবে। রাকিব আর নয়নাও এসেছে ওদের বাড়িতে। রাকিব নয়নার দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। সে ছোট ছোট পায়ে হাটে আর আধো আধো গলায় কথা বলে। নিতু ইভান করে বিয়ে করে তার গ্রামে চলে গিয়েছে। আরাভ কুমায় চলে যাওয়ার পর অফিসের সব দায়িত্ব রাকিবই পালন করেছে। ভূমি মাঝেসাজে একটু আকটু যেত আর কি? ম্যানেজার কাকা তো কোনদিন সঠিক হিসাব করতে পারে না। মাস শেষে স্টাফদের বেতন আর অফিসের সমস্ত হিসাব নিকাশের জন্যে হলেও ভূমিকে যেতে হতো। ভূমি অবশ্য তেমন অফিসে যেতে চাইতো না। রাকিবের জুড়াজুরিতে ওকে অফিসে যেতে হতো। আরাভের ঞ্জান ফেরার কথা শুনে রাকিব অফিসের কাজ ফেলে রেখে চলে আসছে। এমনকি টুকে পাশ করা ম্যানেজারও চলে এসেছে। খন্দকার জুবাইদা ব্যস্ত ছেলের পছন্দের সব রান্না করায়।


বিকেলের দিকে ভূমি আরাভকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে। মেইন দরজায় পা রেখে পুরো বাড়িটা পরখ করে নেয় আরাভ। দুই বছর পা বাড়িতে পা রাখলো সে।ভাবতেই তাসছিল্যের হাসি দিলো সে। আসলে তার মতো হতভাগা আর কে আছে এই দুনিয়ায়। দরজার সামনে আরাভ আর ভূমিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অভি দৌড়ে আসে আরাভের কাছে। অভির বুঝতে বাকি রইলো না এটাই তার পাপা। দাদির কাছে যার গল্প শুনেছে এটাই তো সে। কিন্তু গল্পের আরাভের তো মাথায় চুল বড় ছিলো না। গোঁফ দাড়ি কিছুই ছিলো না। তার পাপার গোঁফ হয়েছে। অভির ধরনা তার পাপা আগে অবিবাহিত ছিলো আর এখন বিবাহিত তাই বড় গোঁফ হয়েছে দাড়ি হয়েছে। এমনকি মাথার চুলগুলো বড় বড়। আরাভের কাছে এসে কোমড় জড়িয়ে ধরে অভি। আরাভ অভির দিকে ভালোকরে লক্ষ করে বুঝতে পারলো এটা তার অভি। সেদিনের সেই ছো্ট্ট অভি আর কতটা বড় হয়ে গেছে। চোখ থেকে দু-ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো আরাভের পিঠে। কেমন বাবা সে। নিজের ছেলেকে চিনতে সময় লাগছে তার। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা সে। আরাভ অভিকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো তারপর সুফার বসে পরলো। তখনি রান্নাঘর হতে বেড়িয়ে আসে খন্দকার জুবাইদা। জুবাইদা এসে আরাভকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আজ আর আরাভ তাকে বাধা দেয় না। কাদুক না, কাঁদলে যদি মনটা হালকা হয় তাহলে ক্ষতি কিসের। একে একে সবার সাথে সাক্ষাৎ হয় আরাভের। রাকিব তো এসেই আরাভকে জড়িয়ে ধরে।সবাই সুফায় বসে কথা বলছে। আরাভের কোলে এখনও অভি বসে আছে। অভি আরাভের গলা জড়িয়ে রেখেছে।পাপাকে কাছে পেয়ে বাকি সব ভূলে গিয়েছে সে।সবাই ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছে আর ভূমি ওদের থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে সবাইকে দেখছে। কতদিন পর তার পরিবারের সবাই একসাথে এক ছাদের নিচে আছে। ভাবতেই চোখ ছল ছল করে উঠলো ভূমির। এমন সময় একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসে ভূমির উড়নার আচল ধরে টানতে থাকে। উড়নার টান অনুভব করে নিচের দিকে তাকায় ভূমি।নিচে ছোট্ট এই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মৃদু হাসে সে। তারপর তাকে কোলে তুলে নেয়। দু গাল টেনে আদর করে দেয় বাচ্চাটার। ভূমি বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে আরাভের কাছে গিয়ে বলে, বাড়িতে তো আরেকটা নতুন মেহমান আসছে তাকে আদর করবে না। ভূমিকার কথা শুনে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় আরাভ। তার মনে প্রশ্ন, কে এই নতুন মেহমান?  


ভূমি বাচ্চাটাকে আরাভের কোলেদেয়। তখন আরাভ অভিকে সুফায় বসিয়ে দেয়। এটা দেখে অভির খুব রাগ হয়। কিন্তু তার পাপার সামনে নিজের রাগটাকে প্রকাশ করতে চায়না আরাভ। নাহলে যে পাপা তাকে পচা বলবে। এই মুহূর্তে পাপার কাছ থেকে পচা ছেলের ট্যাগ নিতে চাচ্ছে না অভি। সে রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছে সেই দুই বছরের বাচ্চা মেয়েটার দিকে।


আরাভ মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বলে, কি কিউটি, এক্কেবারে আমার বউয়ের মতো সফট্ গাল। গুলুমুলু একটা বেবী। আরাভের কথা শুনে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভূমিকা। আর আরাভ অধরোষ্ঠ চেপে হাসে। আদনান মাহবুব গলা খাকড়ি দিয়ে বলে তোমরা কথা বলো আমরা আসছি কেমন। তিনি তার স্ত্রী জুবাইদাকে নিয়ে প্রস্থান করেন। আরাভ বাচ্চা মেয়েটার গালে চুমু খেয়ে বলে,


-ছোট্ট নয়না। এই রাজকুমারীটাকে কি নামে ডাকি বলতো??  


- ভূমি তো মিষ্টি বলেই ডাকে এখন তুইও একটা নাম দে। রাকিবের কথা শুনে স্মিত হাসে আরাভ। আসলে নামটা কিন্ত সুইট। আমার বউয়ের দেওয়া নাম কখনো মন্দহতে পারে না। আজ থেকে আমিও এই রাজকুমারীকে মিষ্টি বলেই ডাকবো। আরাভ মিষ্টির অপর গালে চুমু খেল।এটা দিতে অভি রাগে ফুসছে। এই মুহূর্তে ওর ইচ্ছে করবে কিং কোবরা সাপের বিষ মুখে দিয়ে মিষ্টিকে ছোবল দিতে। বাজে মেয়ে একটা আমার পাপার আদরে ভাগ বসাচ্ছে। এই মেয়েকে তো আমি ছাড়বো না কিছুতেই। না।


আরাভ এখানে বসেই রাকিব নয়না আর ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে থাকে। ভূমি অভিকে নিয়ে তার রুমে চলে যায়। তারপর অভিকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়। এদিকে আরাভ এক কথা দুই কথায় অফিসের কাজের প্রাসঙ্গে কথা উঠে। সেই নিয়ে কথা বলতে বলতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধা হয়ে যায়। 


বিছানায় বসে অভিকে পড়াচ্ছে ভূমি এমনি সময় রুমে আরাভের প্রবেশ। আরাভকে দেখে তো অভি লাটে উঠে যায়। সে পড়া বাদদিয়ে আরাভের কোলে উঠে গিয়ে। ভূমিও কিছু বলে না। আরাভ অভিকে কোলে নিয়ে ভূমির পাশে এসে বসে। বাবা ছেলেকে দেখে ভূমি আনমনে হেসে উঠে। আরাভ ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে এক হাত দিয়ে তাকেও নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তখন অভি আরাভের লম্বাচুলে হাত ডুকিয়ে দিয়ে বলে,


-পাপা তুমি কি ফোক গান গাও তোমার চুল এত বড় কেন? জানো পাপা ফোক গান আমার অনেক ভালো লাগে। ছেলের কথার কোন জবাব দেয় না আরাভ। ভূমি বলে উঠে, 


-আসলে অনেক দিন চুল কটেনি তো তাই বড় হয়ে গেছে। কাল সকালে উঠেই দেখবে পাপার চুল ছোট ছোট হয়ে গিয়েছে। ভূমির কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো অভি। তারপর সে বলল,


-তুমি আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না তো পাপা??জানো স্কুলে সবার পাপা মাম্মা যায় শুধু আমার পাপাই যায় না। আরাভ অভিকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলে,


-কোথাও যাব না। তোমাদের ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।


-কি মজা, কি মজা, পাপা এখন আমাদের সাথেই থাকবে। অভি আরাভের কোল থেকে নেমে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ভূমি উঠে ওর পিছু যেতে চাইলে আরাভ ভূমির হাত ধরে ফেলে। ভূমি হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে আরাভের দিকে তাকায়। তখন আরাভ ভূমির হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়। ভূমির কোমড়ে হাত গুজে দেয় আরাভ। তারপর ভূমির গলায় মুখ গুজে দিয়ে বলে,


-তোমাকে বলেছিলাম সব সময় শাড়ি পরতে। বর তুমি থ্রি-পিছ পরেছো। আমার কথা অমান্য করাটা তোমার ধর্ম তাইনা। কথা বলার সময় আরাভের অধর স্পর্শ করছে ভূমির গলায়। আর ভূমি কেপে কেপে উঠছে।


-আ-আমিও বলেছিলাম তোমাকে, যতবার শাড়ি পরবো ততবার তুমি শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে।


-ওকে ফাইন, যাও শাড়ি নিয়ে এসো। শুধু কুচি ঠিক করেই দিবো না। শাড়িটাও পড়িয়ে দিবো আজ।


-মানে!!!!


-এত অবাক হওয়ার কি আছে। আজ প্রথম দিবো নাকি?? ভূমির কোমড়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলল আরাভ। 


-তুমি না সত্যিই একটা অসভ্য। সারাক্ষণ অসভ্যতামি করো। ছাড়ো আমাকে।


-তোমার এই ছটফটানি আর গেলো না। চুপচাপ বসে থাকো এখানে নাহলে।


-না হলে কি? ভ্রু কুচকিয়ে বলল ভূমি।


-অসভ্য বললে না আমাকে। সেটা প্রেকটিক্যালি করে দেখাবো। আরাভের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো ভূমিকা। তারপর বলল,


-এক ছেলের বাপ হয়েছে এখনো অসভ্যতামি করছো এটা ঠিক না।


-শুরুটা তো তুমিই করেছিলে জান। বলেই চোখ টিপ দিলো আরাভ। ভূমি লজ্জা পেয়ে আরাভের শার্টের কলার ধরে বুকে মুখ গুজে দিলো।

#বেলা_শেষে। [২৮]


আরাভ ভূমিকে তার পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে নেয়। তারপর তার দুটি হাত গুজে দেয় ভূমির কোমড়ে। ভূমি দু হাত দিয়ে আরাভের গলা জড়িয়ে ধরে। এমতাবস্থায় আরাভ হেটে হেটে বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় এসে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে কিছুক্ষণ। কেও কোন কথা বলে না। শুধু দুজন দুজনকে অনুভব করছে। আর এরে অপরের হৃদস্পন্দন শুনছে।


-ভূমি,,,। আরাভের কোমল কন্ঠে শুনে ভূমির মনে ভিতরে হীম শীতল হাওয়া বয়ে যায়। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যার মনের ভিতরে। তবে এই অনুভূতির সাথে ভূমি আগে থেকেই পরিচিত। ভূমি কাপাকাপা গলায় বলল,


-অভি এসে পরবে, ছাড়ো আমাকে?? ভূমির জড়ানো কন্ঠ শুনে মৃূদু হাসলো আরাভ। তারপর ভূমিকে উল্টোদিকে ঘুড়িয়ে নিলো। পিছন থেকে ভূমিকে জড়িয়ে ধরে ওর কাদে থুতনি রাখলো আরাভ। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো, 


-কেও আসবে না জান। দেখো গিয়ে অভি হয়তো ওর দাদুর কোলে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনছে। জান, এই জানপাখি এখনো এত লজ্জা কেন পাচ্ছো হুম। ও আচ্ছা অনেক দিন ওর তোমার কাছে এসেছি এর জন্যে। কিন্তু তুমি তো লজ্জা পাওয়ার মতো মেয়ে নও। নিজের অধীকার কি ভাবে আদায় করতে হয় সেটা তোমার থেকে ভালো আর কে জানে বলো। ভূমির কানের লতিতে আলতো করে চুমু খেলো আরাভ। আর কিছু বলতে পারলো না আরাভ। তার আগেই ভূমি আরাভকে ধাক্কাদিয়ে দূরে সড়িয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে কিছুটা দূরে সরে যায় আরাভ। নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পেরেছিল বিধায় নিচে পরে যায়নি সে। অন্যথায় নিচে পরে যেত। ভূমি কোমড়ে হাত গুজে রণচণ্ডী রুম নেয়। তারপর তর্জনী তুলে বলে,


-এবার বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বললাম। আর যদি একটা কথাও বলেছো তাহলে তোমাকে,,


-আবারও চুমু খাবে। আমার কোন প্রবলেম নেই। একটা কেন হাজারটা চুমু খেতে পারো তুমি, অধার্ঙ্গিনী বলে কথা। ভূবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল আরাভ। আরাভ ভুমির দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বলল, তুমি চাইলে এখনি চুমু খেতে পারো। আমি মাইন্ড করবো না। আরাভের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় ভূমির মুখ। সে আরাভকে আবারও ধাক্কা দেওয়ার জন্যে হাত উঠাতেই আরাভ ওর হাত ধরে ফেলে নিজের কাছে টেনে নেয়ব। আর ভূমির অধরোষ্ঠে আরাভ তার অধর বসিয়ে দেয়। আরাভের এমন কান্ডে চোখ রসগোল্লার মত হয়ে যায় ভূমির। সে বড় বড় চোখ করে অতীতে ডুব দেয়।


খন্দকার আজহার ভূমির বাবা মাকে শহরে নিয়ে আসে। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আরাভ ভূমির বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভূৃমি প্রথমে আপত্তি করলেও পরে সে সহজেই বিয়েটা মেনে নেয়। কারন আর যাই হোক আরাভের মতো মানুষ কাওকে ঠকাবে না। সোহাগ রাতে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ফুলের সাজানো বিছানায় বসে আছে ভূমি। স্বাভাবিক ভাবেই আজও ভূমির মনে রয়েছে এই রাত নিয়ে হাজারো কল্পনা কল্পনা। আরাভ রুমে আসবে, ভূমির ঘোমটা তুলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে ভূমির দিকে।আর ভূমি লজ্জায় মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পরবে। আরাভ ভূমির লজ্জামাখা মুখখানি উপভোগ করবে। তারপর সে ভূমির হাতের উল্টোদিকে গভীর ভাবে চুমু খাবে। আরো নানান কল্পনায় ব্যস্ত ভূমি।এমনি সময় দরজা খোলার শব্দ কানে আসলো ভূমির। আরাভ রুমে এসেছে। ভূমি তার হাত পা গুটিয়ে বসলো। ঘোমটার আড়ালে থেকে ঠোঁট কামড়াচ্ছে আর বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে ভূমি। আরাভ রুমে এসে তার বর টুপি টেবিলের উপর রাখলো। তারপর তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বিছানায়। লম্বা ঘোমটার আড়ালে থাকা তার বউয়ের দিকে। ভূমি আরাভের বিয়ে করা বউ। ভাবতেই কেমন খুশি খুশি ফিল হচ্ছে আরাভের। স্মিত হাসলো আরাভ। তারপর ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলো সে। আলতো হাতে ভূমির ঘোমটা তুলে দিলো। লজ্জায় ভূমি তার চোখ বন্ধকরে নিলো। আরাভ মুগ্ধ চোখে ভূমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ইচ্ছে করছে ভূমিকে একটু ছুইয়ে দিয়ে। তার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিতে। ভূমিকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন আরাভ সেটা কিছুতেই করবে পারবে না। সে যে ভূমিকা কথা দিয়েছে। ভূমি যতদিন না আরাভকে মন থেকে মেনে না নিবে ততদিন আরাভ ভুমিকে স্পর্শও করবে না। খুব কষ্টে নিজের পুরুষত্ব দমিয়ে নিলো আরাভ। বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, 


-অনেক রাত হয়েছে ফ্রেশ হয়ে নাও।


চট করে চোখ খুলে ভূমি। চোখের সামনে আরাভকে দেখতে না পেয়ে পাশে তাকালো।ওহ,ওনি ওখানে। ধুর, কি সব ভাবছি আমি। ভূমি তোর আবার হলোটা কি, কি সব ভাবছিস ওনাকে নিয়ে। নিজেই নিজের মাথায় চাপট মারলো ভূমি। তারপর ওয়াশরুমে চলে যায়। ভূমির চলে যাওয়ার পর বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে আরাভ। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে প্রাপ্তির হাসি। ফাইনালি ভূমিকে আপন করে পেলো সে। তারপর শেরওয়ানী খুলে টাওজার আর টি-শার্ট পরে নেয় আরাভ। তারপর বালিশ আর একটা চাদর নিয়ে সুফায় শুয়ে পরে।


ভূমি ফ্রেশ হয়ে এসে যখন দেখে আরাভ সুফায় শুয়ে আছে তখনি তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখন তো ওদের বিয়ে হয়েছে তাহলে আলাদা কেন থাকবে। সাধারণ ভাবেই কি জিবন যাপন করতে পারে না। কেন তাদের জিবনটা এত জটিল। আচ্ছা তার সাথে কি আরাভের সম্পর্কটা এমনি সব স্বামি স্ত্রীর মতো হতে পারে না। যারা সুখে দুঃখে একে অপরের পাশে থাকে। হ্যা হতেই পারে। আরাভ তাতে কিছুতেই কষ্ট পেতে দিবে না এটা জানে ভূমি। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সুফার পাশে এসে দাঁড়ালো। আরাভ কপালে হাত দিয়ে দু-চোখ বন্ধকরে রেখেছিল এতক্ষণ। ভূমি এখানে এসে দাঁড়াতেই আরাভ তার উপস্থিতি বুঝতে পারলো। সে কপাল থেকে হাত নামিয়ে ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূমির দিকে। ভূমিকে ভাবনার জগতে ঘুরপাক খেতে দেখে আরাভ বলে উঠলো,


-আমাকে খুন করার প্ল্যান করছো নাকি?? আরাভের কথায় ভূমির ধ্যান ভাঙে। সে সামনে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,


-আপনার এমনটা কেন মনে হলো?? 


-তাহলে কি ভাবছিলে?? 


-ক-কই কিছু ভাবছিলাম না তো। বলছি আপনি কি এখানেই ঘুমাবেন না কি?? 


-কি আর করবো। তোমার পাশে তো ঘুমাতে দিবে না। ভূমির বলতে ইচ্ছে করছে, আমি কি আপনাকে মানা করছি না। আপনি আসুন না আমরা এক সাথেই ঘুমাই। প্রবলেম কোথায় আমরা তো স্বামি স্ত্রী তাই না। কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখে প্রকাশ করলো না ভূমি। কি জানি আরাভ আবার ওকে কি ভাববে। ভূমি নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে আসলো। তারপর বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। আরাভ মাথা উচু করে ভুমির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর মৃদু হেসে সেও পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে।


এভাবেই কেটে যায় সপ্তাহ খানেন। আরাভ তখনো আলাদাই ঘুমাতো। এতে ভূমির অনেক খারাপ লাগতো। সে আরাভ কে বারবার বলতে চাইতো একসাথে থাকার কথা। কিন্তু বলতে গিয়েও প্রতিবার না বলে ফিরে আসতো। আরাভ যে বুঝে নি সেটা নয়।আরাভ ও বুঝতে পারছে। কিন্ত প্রবলেম হলো ভূমি যতক্ষণ মুখে না বলবে সে ভূমির কাছে আসবে না। বিয়ের নয় দিনের দিন রাতে। আরাভ বালিশ নিয়ে মাত্রই সুফায় বসেছে এমনি সময় ভূমি এসে আরাভের হাতের বালিশ ধরে বলল,


-আপনি আর এখানে ঘুমাবে না। ভূমির কথায় ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো আরাভ।অতঃপর সে বলে উঠল,


-বিছানায় ঘুমাতে পারবো না। সুফায় ঘুমাতে পারবো। তাহলে কি? এখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।


-সেটা কখনো বললাম। আরাভের হাত থেকে বালিশ নিয়ে সেটা বিছানায় রেখে বলল ভূমি। আপনি আমার সাথে এক বিছানাতেই ঘুমাবেন।


-ভেবে বলছো। ভ্রু নাচিয়ে বলল আরাভ। 


-হ্যাঁ, ভেবেই বলছি। 


-কিন্তু আমি তোমার সাথে এক বিছানায় কেন ঘুমাবো। হোয়ায়? আবারও ও বালিশ হাতে নেয় আরাভ। ভূমি আরাভের হাত ধরে বলে,


-বালিশ কেন নিচ্ছেন আপনি?? 


-তোমার আজাইরা বকবক শুনার সময় নাই এখন। আমি ঘুমাবো কাল সকালে একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। হাত ছাড়ো আমার।


-আমি আজাইরা বকবক করি?? কোমড়ে হাত রেখে একটু রাগ দেখিয়ে বলল ভূমি।


-ইয়াহ। হাত ছাড়ো।


-নাহ ছাড়বো না। কি - কি করবেন আপনি?? আরাভ বালিশ ছেড়ে দিয়ে ভূমির দিকে দুকদম এগিয়ে যায়। তাতে ভূমিও দু পা পিছিয়ে যায়। আরাভ ভ্রু কুচকিয়ে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে বলে,


-তোমার মতলবটা কি বলতো?? 


-ম -মতলব। কিসের মতলব??  


-আমাকে এত আটকাচ্ছো কেন হুম। 


-আপনি সুফায় শুতে পারবেন না। তাই আটকাচ্ছি।


-আমি সুফাতেই ঘুমাবো। এভাবে তুমি আমাকে আটকাতে পারবে না। ভূমির সামনে থেকে সরে এসে আবারও বালিশ হাতে নেয় আরাভ।তখন ভূমির খুব রাগ লাগে। বেটা এনাকোন্ডা, এভাবে আমাকে আটকাতে পারবে না। আপনাকে যে ভাবে আটকাতে পারবো আমি সেই ভাবেই আটকাবো। ভূমি দ্রুতগতিতে আরাভের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আরাভ ভ্রু কুচকিয়ে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকায় ভূমির দিকে। ভূমি কোন জবাব না দিয়ে আরাভের টি শার্টের কলার ধরে অধরে চুমু খেয়ে বসে। ততক্ষণাৎ আরাভের হাত থেকে বালিশ পরে যায়। ঘটনাটা বুঝতে আরাভের সাময় লাগে কয়েক সেকেন্ড। আরাভ যখন বুঝতে পারে সেও তার এক হাতে ভূমির কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্যহাত ভূমির চুলে ডুবিয়ে দেয়।  


জানালার পর্দা বেদ করে সূর্যের রশ্নি এসে মুখে পরতেও মোচড় কটে ভূমি। আরাভ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিসে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছিল। ভূমিকে মোচড় কাটতে দেখে জানালার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাস টেনে তার উপর পর্দা টেনে দেয়। রেডি হয়ে নিচে যায় আরাভ। তারপর ভূমির পছন্দের চা করে নিজে হাতে। কত দিন পর তার প্রিয়সীর জন্যে নিজে হাতে চা করছে সে। ভূমির পছন্দের চা করে এনে টেবিলের উপর রাখে। তারপর সে ভূমির পাশে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ প্রিয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আরাভ। তারপর ভূমির কপালে ভালোবাসার পরশ একেদিয়ে, মৃদু সুরে বলে,


-গুড মর্নিং জান। চট করে চোখ খুলে আরাভ। আরাভকে দেখে বড়সড় শখ খায় ভূমি। কালকের আরাভ আর আজকের আরাভের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আরাভ চুল গোঁফ দাঁড়ি কাটলো কখন। তবে যখনই কাটুকনা কেন? ভালো হয়েছে। কলতো ওকে পাগলের মতো দেখতে লাগছে। আর এখন তো সেই পুরনো আরাভ হয়ে গেছে সে। সেই চোখ, সেই নাক, সেই খোচা খোচা দাড়ি। ঠোটের কোনে লেপ্টে থাকা সেই হাসিটা। ভূমি আবারও নতুন করে আরাভের প্রেমে পড়লো। সে আনমনেই আরাভের গালে হাত রাখলো। তারপর সে আরাভের দাঁড়িতে হাত বুলাতে লাগলো। আরাভ স্মিত হেসে ভূমির হাত ধরে হাতের উল্টোদিকে চুমু খেলো। তারপর বলল,


-এভাবে কি দেখছো?? উঠো, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভূমি মৃদু হাসলো এই ভেবে, এতদিন পরেও সে ভূমির পছন্দের চা করেছে।


পাপা পাপা আমি রেডি, কোথায় তুমি। রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল অভি। অভি রুমে ডুকতেই ভূমি আরাভের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসে। আরাভ উঠে অভির কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। অভি তার আরাভের গলা জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু খায়। তারপর বলে,


-আজ তুমি আমার স্কুলে যাবে?? 


কোথায় যাবে তোমরা?? বিছানায় বসে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ভূমি। আরাভ ভূমির দিকে ঘুরে জবাব দেয়,


-অভিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি অফিসে যাব।


-ওহ। একটু ওয়েট করবে? আমিও যাব তোমাদের সাথে।


-তুমি কোথায় যাবে অফিসে নাকি কলেজে??


-নয়না আপুর বাসায়। আসলে মিষ্টিকে দেখতে যাব। কি কিউট বাচ্চা।


-রোজ রোজ মিষ্টিকে দেখতে যাওয়ার কি প্রয়োজন। আমাকে বললেই পারো। মিষ্টির মতো একটা কিউট সুইট বেবী গিফ্ট করে দেই । ঠোটের কোনে দুষ্ট হাসির রেখা টেনে বলে আরাভ। আরাভের কথা শুনে ভূমি বালিশ ছুড়ে মারে ওর দিকে। দুর্ভাগ্যবশত আরাভ বালিশটা ধরে ফেলে। অভি ততক্ষণে আরাভের কোল থেকে নেমে যায়। আরাভ বালিশে আড়ালে মুখ লুকিয়ে ভূমিকে ফ্লায়িং কিছ ছুড়ে মারে। তারপর বালিশটা বিছানায় রেখে দেয়। অভিকে কাছে টেনি নিয়ে অভির মাথায় হাত বুলায় আরাভ তারপর জিগ্যে করে,


-তোমার ছোট্ট বোন চাই তাই না বাবা।


#বেলা_শেষে। [২৯+৩০]


তোমার ছোট্ট একটা কিউট বোন চাই তাইনা বাবা। অভিকে অতি আদর করে জিগ্যেস করলো আরাভ। বাবার এমন আদর পেয়ে কোন কিছু না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দিলো অভি। হ্যাঁ তারও ছো্ট্ট একটা সুইট কিউট গুলুমলু বোন চাই। অভির স্বিকারোক্তি পেয়ে আরাভ ভূমির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। ঠোঁঠের কোনে ফুটে উঠলো তার বিজয়ী হাসি।ছেলেটাও যে তার কথার সায় দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আরাভের মুখে এই বিজয়ী হাসি বেশীক্ষণ টিকে রইলো না। অভির বলা কথায় মুহূর্তেই আরাভের মুখের হাসি উবে গেলো।


-না আমার কোন বোন চাই না। আমি একা পাপার আদর খাবো।


অভি তখন কিছু না বুঝেই তার বাবার কথায় তাল মিলিয়ে বলেছিলো তার সুইট কিউট বোন চাই। পরক্ষনেই যখন কালকের ঘটনা মনে পড়লো তার। আরাভ তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে আদর করছে তখনি মন খারাপ হয়ে যায় অভির। তারমানে অভির যখন বোন হবে তখন তার পাপা তাকে আর আদর করবে না। সব আদর বোনকে দিবে। কিন্ত সে তো তার পাপার আদর কারো সাথে ভাগ করবে না। তাই সে তড়িৎগতিতে বলে উঠে আমার কোন বোন চাইনা।


অভির কথা শুনে আরাব ও ভুমি দুজনেই বড় বড় চোখ করে অভির দিকে তাকায়। ভূমি মনে মনে বলে, এই ছেলেটার মনে এখনি এত হিংসা। বড় হলে না জানি কি কি ঘটাবে।


দুই বছর তিন মাস চারদিন পর আজ অফিসে এসেছে আরাভ। আজকের দিনটা সেলেব্রিট না করলে কেমন হয়। অফিসের সকল স্টাফ একটা ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করেছেন। আর এদিকে আরাভ নিজের কেবিনে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। এমন একটা দুর্ঘটনার পরেও আরাভ বেঁচে আছে। তার পরিবারের সকলে তার সাথে আছে সেই আনন্দে কোন দিকে মন দিতে পারে নি সে। পরিবার নিয়েই মেতে ছিলো সে। মাহিনের কথাটাও জানা হয়নি তার। মাহিন এখন কোথায় আছে কেমন আছে সেটাও জানে না আরাভ। তবে মাহিন যেখানেই থাকুক না কেন তাকে খুজে বের করে শাস্তি দিবে আরাভ। পৃথিবীর যে প্রান্তেই লুকিয়ে থাকুক না কেন আরাভ তাকে খুজে বের করে নিজের হাতে শাস্তি দিবে। ওর মতো একটা নরকের কীট বেঁচে থাকার কোন অধীকার নেই। ওকে মরতেই হবে। চেয়ার হেলান দিয়ে বসে দু-চোখ বন্ধকরে ভাবছে আরাভ। 


বাহিরের সব কাজ চুকিয়ে রাকিব আসে আরাভের কেবিনে আরাভকে ডাকতে। আরাভের জন্যে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে আরাভ বা থাকলে পার্টি শুরু হবে কি করে। আরাভকে ডাকতেই এখানে আসে রাকিব। কেবিনে ডুকে আরাভকে এমন চিন্তিত অবস্থায় দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় রাকিব। আরাভের মনের ভেতরে এখন কি চলছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না রাকিবের। আরাভের হাতের মুঠিতে মুচড়ানো কাগজ দেখেই বুঝতে পারছে রাকিব। রাকিবের ধারনা যদি সঠিক হয় তাহলে আরাভের কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে তাকে। কিন্ত এই মুহূর্তে রাকিব সেটা করতে চাচ্ছে না। সে আরাভের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছে রাকিব। এমনি সময় একটা চেয়ারের পায়ার সাথে রাকিবের পা লেগে যায়।যার পরে চেয়ারের থেকে একটু শব্দ হয়।এই শব্দে কানে আসতেই চোখ খুলে আরাভ। রাকিব পরে যেতে যেতে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। আরাভ ভ্রু কুচকিয়ে রাকিবের দিকে তাকাতেই রাকিব ইনোসেন্ট মুখ করে আরাভের দিকে তাকায়,


-রাকিব তুই এখানে?? কখন এলি?? 


-এইতো এখনি এলাম।


-ওহ। 


-ওদিকে সবাই তোর অপেক্ষা করছে, তুই গেলেই পার্টি শুরু হবে। কথাটা বলেই রাকিব কয়েক কদম এগিয়ে যায় চলে যাওয়ার জন্যে। তখন আরাভ রাকিবকে পিছন থেকে ডাক দেয়। আরাভে এমন গভীর গলা শুনে থমকে দাড়ায় রাকিব। ঠিক যেন এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে। শুকনো একটা ডুক গিলে পিছনে ফিরে তাকায় রাকিব। আরাভ তার চেয়ার ছেড়ে রাকিবের পাশে এসে দাঁড়ায়। খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়ে নেয় সে।তারপর রাকিবের মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করে ভয়েজ দৃঢ় করে বলে,


-মাহিন এখন কোথায়?? আরাভের প্রশ্নশুনে আবারও শুকনো ডুক গিলে রাকিব। ভয়ার্ত চোখে আরাভের দিকে তাকায় সে। কিন্তু আরাভের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।


-তোকে কিছু জিগ্যেস করছি রাকিব। হোয়ার ইজ মাহিন? আ্যানসার মি।


রাকিব এবারো তার মুখ খুলে না। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আরাভের মুখপানে। বিরক্ত হয়ে আরাভ রাকিবের দুই বাহুকে শক্তকরে চেপে ধরে। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে রাকিবের দিকে তারপর চেঁচিয়ে বলে,


-রাকিব চুপ করে থাকিস না। বল মাহিন কোথায় আছে। দেখ ও যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন ওকে খুজে আমি বের করবোই। আমার ভূমির গায়ে হাত দেওয়া শাস্তি আমি ওকে দিবোই। ওর কলিজায় কত সাহস না। ওর কলিজাটাই বে করে নিবো আমি। দেখ রাকিব এমনিতে আমার জিবন থেকে দুই বছর চলে গেছে। আর সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। তুই যদি জেনে থাকিস মাহিন কোথায় আছে সেটা বল আমাকে।


-মাহিনের শাস্তি হয়েছে। বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল রাকিব। রাকিবের কথা শুনে আরাভের হাত আলগা হয়ে আসলো। সে রাকিবের বাহু ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বাতাশে প্রতিধ্বনির মতো এখানো কথাটা তার কানে বাঝছে। রাকিবের শাস্তি হয়েছে। এই বাক্যটা তার কাছে এত ভারী কেন লাগছে। আরাভ তো চাইছে নিজের হাতে মাহিনকে শাস্তি দিতে। তার কলিজাটা বের করে নিতে।মাহিনের শাস্তি হয়েছে মানে তো সে মাহিনকে আর কিছুই বলতে পারবে না। রেগে হাতের শক্ত মুঠি করে নিলো সে। তারপর টেবিলের উপর ঘুসি মারলে। সেখানে কাচ লাগানো ছিলো তাই আরাভের হাত কেটে যায়। আর সেখান থেকে রক্ত পরতে থাকে। রাকিব ওর হাত ধরতে চাইলে সে হাত উচু করে রাকিবকে আটকিয়ে দিবে বলে,


-এ তো সামান্য। সেদিন এর থেকেও বেশী রক্ত ঝড়ছে আমার ভূমির শরীর থেকে।


-আর তোর?? তোর শরীর থেকে কোন রক্ত ঝড়েনি। রাকিবের কথার কোন জাবাব দিলো না আরাভ। সে হাতটা ঝকিয়ে নিলো। অতঃপর বলল,


-মাহিনের শাস্তি হয়েছে মানে কি?? কিসের শাস্তি হয়েছে ওর!! আর কে ওকে শাস্তি দিলো?? 


-রিল্যাক্স আরাভ। একসাথে এত প্রশ্ন করলে কোনটার জবাব দিবো বল। তুই শান্ত হো বস এখানে। তারপর রাকিব আরাভকে তার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলে,


-মাহিনের শাস্তি হয়েছে। আইনি ভাবে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। আর ওকে এই শাস্তি কে দিয়েছে জানিস??  


-কে? রাকিবের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু সুরে বলল আরাভ।


-ভূমি। হ্যাঁ তোর ভূমি নিজে কোর্টে ওর প্রতিপক্ষ লো- ইয়ার হয়ে ওকে শাস্তি দিয়ে। আর কি শাস্তি দিয়েছে জানিস?? একজন ধর্ষণের শাস্তি হয়েছে ওর। রাকিবের কথা শুনে হাসলো আরাভ। এই শাস্তি তার পছন্দ হয়নি। সে তো মাহিনকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিতে চেয়েছিল। বিরক্তি প্রকাশ করা ভঙ্গিতে বলল,


-কি শাস্তি হয়েছে ওর। যাবজ্জিবন কারাদণ্ড।


-নাহ মৃত্যুদণ্ড। মেয়েদের ভালোবাসার ফা্ঁদে ফালিয়ে তাদের সম্মান নেওয়া, চারজনকে ধর্ষণ ভূমিকে দুইবার ধর্ষন করার চেষ্টা আর তোকে প্রানে মেরে ফেলার চেষ্টা করার কারনে আদালত ওকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেছে।


আইনের ৯/১ ধারায় ধর্ষণের জন্য সাজা ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, এটি সংশোধন করে ১২ অক্টোবর ২০২০ মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী।


এখন থেকে ধর্ষণের শাস্তি হবে হয় মৃত্যুদণ্ড না হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। 


আরাভ এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে।মাহিনের মৃত্যুর খবর শুনে এবার ভালো লাগছে তার।এখন অন্ততপক্ষে মেয়েরা নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে। মাহিনের মৃত্যুটা যদি আরো আগে ঘটতো তাহলে এতগুলো মেয়ে ধর্ষণের স্বীকার হতো না।


অফিসের পার্টিতে যোগ দিয়েছে ভূমি অভি নয়না ও তার মেয়ে মিষ্টি। পার্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ওরা অফিসে আসে। আসলে অফিসে পার্টির কথা নয়নাকে আগেই জানানো হয়েছিল কিন্তু সময়টা বলে দেয়নি ওদের।তাই আসতে লেট হয়েছিলো। পার্টি চলাকালীন সময়ে আরাভ ভূমিকে নিয়ে ও রাকিব নয়নাকে নিয়ে কাপল ডান্স করে। এদিকে মিষ্টি একা একা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে কিছুক্ষণ। তারপর সে অভির কাছে এগিয়ে যায়। আসলে তখন অভির হাসে একটা চকলেট বক্স ছিলো। আর সেটা দেখেই মিষ্টি অভির কাছে এগিয়ে যায়। মিষ্টিকে দেখে অভির খুব রাগ হয়। তাই সে মিষ্টির দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তাতে মিষ্টি ভয় পাওয়ার পরিবর্তে খিলখিল করে হেসে দেয়। আসলে অভির ভ্রু কুচকিয়ে কপালের ভাজ আর নাক ফুলানো দেখে বেশ আনন্দ পায় মিষ্টি তাই সে হেসে দেয়।


দমকা হাওয়ায় ঘুরপাক খেয়ে,

ঘুটঘুটে অন্ধকারে শূন্যতায় পতিত আমি।

আদুরে মিষ্টি সুরে কেউ সমবেদনা জানায়নি,

ভালোবাসার আঁচলে বাঁধা হইনি তাই হয়তো

ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস আমাকে ছাড়েনি।


বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিংএ হাত রেখে বাহিরের অন্ধকারে ডেকে থাকা শহরের দিকে তাকিয়ে একমনে বলল ভূমি। মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার। রাকিব তো আরাভকে সবটা বলে দিয়েছে। এই নিয়ে আরাভ যদি ওকে কোন প্রশ্ন করে তাহলে কি বলবে ভূমি। আরাভকে তো সব সত্যিটা বলতে পারবে না সে। তাহলে আরাভ উল্টো রিয়্যাক্ট করবে। এই লুকোচুরি আর ভালোলাগছে না তার। বিশেষ করে আরাভের থেকে কোন কি আড়াল করতে তার একদমই ভালো লাগে না। কিন্ত ভূমি এখন কি করবে। আরাভ যদি তাকে তার ক্যারিয়ার নিয়ে কোন প্রশ্ন করে তখন কি বলবে ভূমি। সত্যিটা বলে দিবে। হ্যাঁ এটাই ভালো। অন্ততপক্ষে আরাভের থেকে কিছু আড়াল তো হবে না।


আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও আরাভ। আমি পারিনি তোমার কথা রাখতে। মানুষের ক্ষমতার কাছে নিজের স্বপ্ন নিজের ক্যারিয়ার সব কিছু বিক্রি করে দিয়েছি। পারিনি নিজের স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে। তবে অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছি। তোমাকে যে মৃত্যুপথে ঠেলে দিয়েছিলো তাকে শাস্তি দিতে পেরেছি এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।


অভির হাত ধরে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে আরাভ। ডিনার শেষে বাপ ছেলে মিলে বাহিরে গিয়েছিল। অভির অনেদিনের ইচ্ছে চিলো সে তার পাপার কাদে উঠে রাতের শহর দেখবে। অভির সেই ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিতেই আজ ওরা বাহিরে গিয়েছিলো। আরাভ যখন অভির হাত ধরে রুমে আসে তখন পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে ভূমিকে দেখতে পায় না। বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই দেখে ভূমি রেলিং এর উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আচল নিচে পরে ফ্লোরের সাথে লেপ্টে আছে। জানালা দিয়ে বাহিরের ধমকা হাওয়া এসে বারবার নাড়িয়ে দিচ্ছে ভূমির চুল। আরাভ মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আনমনেই সে বলে উঠলো,


-এলোকেশরী। আমার এলোকেশরী  


পাপা চল আমরা ঘুমাবো। আরাভের হাত টেনে বলল অভি।অভির কথায় ঘোর কাটে আরাভের। সে অভির দিকে তাকিয়ে বলে,


-তুমি বেডে যাও আমি আসছি। অতঃপর অভি চলে যায়। আরাভ আবারও তার দৃষ্টি স্থাপন করে তার এলোকেশরীর দিকে। বুকের উপর হাত গুজে দিয়ে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর মনে মনে বলল,


-আর কত ভাবে কত রুপে তোমার প্রেমে পড়বো বলতে পারো এলোকেশরী।আই এমন অলরেডি ম্যাডলি ইন লাভ উইথ ইউ। এখন কি সন্যাসি হবো নাকি। 


-পাপা আসো না। বিছানা থেকে ডাক দিলো অভি। আরাভ অভির দিকে তাকিয়ে বলল, আসছি। অতঃপর আরাভ অভির কাছে যায়। আর ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুৃম পাড়িয়ে দেয়। অভিকে ঘুম পাড়িয়ে আরাভ ভূমির কাছে চলে যায়। ভূমি এখনো আগের অবস্থাতেই দাড়িয়ে ছিলো। 


রেলিংএ থাকা ভূমির হাতের উপর হাত রাখে আরাভ। ভূমি কিৎচিত মাথা নাড়িয়ে বলে,


-ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো শেষ।


-এখনো ঘুমাও নি কেন?? 


-ঘুম আসছে না।


আরাভ ভূমির দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে দাঁড়ালো। আবছা আলোতে ভূমির মুখটা সে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে ভূমি কোন কিছু নিয়ে বেশ চিন্তুিত আছে। আরাভ এক হাতে ভূমির চিবুক ধরে মাথটা উঁচু করে নিলো।


-কি হয়েছে ভূমি?? তোমাকে এত চিন্তিত কেন লাগছে।


-ক-কই না তো। কি যে বলো না তুমি আরাভ। এখন আর কি নিয়ে চিন্তা করবো আমি। তুমি তো আমার পাশেই আছো তাই না। আরাভের বুকে মাথা রাখলো ভূমি। আরাভ দু-হাতে তার প্রিয়সীকে আলতো করে জড়িয়ে নিলো। 


পরের দিন সকালে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করছে এমনি সময় ড্রয়িংরুমে থাকা ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো। এখন আবার কে কল করলো। খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় জুবাইদা। কারন বাড়ির ল্যান্ডফোনে সাধারণত তার শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া অন্যকেও কল করে না। তাই জুবাইদা উঠে গেল কল রিসিভ করতে। কিন্ত কল রিসিভ করে জুবাইদা বেশ হাসিখুশি হয়ে আপনে আগ্গে সম্বোধন করে কথা বলে। তারপর জুবাইদা খবার টেবিলে বসে আরাভকে বলে উঠে,


-আজ তোমার অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। আরাভ কাটা চামচ দিয়ে এক টুকরো সালাদ মুখে পুরে বলে,


-আবার কার সাথে দেখা করতে যেতে হবে বলো। আরাভের কথা শুনে জুবাইদা বেশ চটে গেলেন। এই ছেলেটা সবসময় মজা করে।


-ভূমির বাবা কল করেছিল। তিনি তোকে আর ভূমিকে তার বাড়িতে ডেকেছে। আর আজ তুই সেখানেই যাবি  


-আর আমি!! আমি যাব না তোমাদের সাথে। দুধের গ্লাস রেখে বলল অভি। অভির কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। খন্দকার জুবাইদা অভির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,


-তুমিও যাবে দাদুভাই। আর হ্যাঁ তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে কেমন। দাদু কিন্ত তার ইয়াং বয়ফ্রেন্ডকে ছাড়া বেশীদিন থাকতে পারবে না। অভি মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দিলো।


ভূমির গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধাহয় ওদের। সারাদিন জার্নি করে খুব টায়ার্ড হয় সকলে তাই রাতে ডিনার করে আগেই ঘুমিয়ে পরে। পরেরদিন সকালে ভূমি অভিকে নিয়ে তাদের গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখায়। গ্রামের এই সবুজ স্যমল ফিরোজা রুপালি প্রাকৃতিক দৃশ্যবলি দেখে মন ভরে যায় অভির। বইয়ের পাতায় গ্রামের দৃশ্যবলি দেখেছে সে। কিন্ত বাস্তবে গ্রাম দেখতে এত মনোরম সেটা বুঝতে পারেনি। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে হাঁটার সময় অভি লক্ষ্য করে, রাখাল মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে। হাতে তার বাঁশের বাঁশি। কৃষকেরা ভাটিয়ালি গান গাইতে গাইতে মাঠে কাজ করছে। মুহূর্তে মনে পড়ে আ.ন.ম. বজলুর রশিদের কবিতার আংশিক অংশ,


রাখাল বাজায় বাঁশি কেটে যায় বেলা,

চাষী ভাই করে চাষ কাজে নাই হেলা।

সোনার ফসল ফলে ক্ষেত ভরা ধান,

সকলের মুখে হাসি গান আর গান। 

 

-ইটস্ প্রিটি আম্মু। কত সুন্দর গ্রাম। ছেলের কথা শুনে হাসলো ভূমি। প্রতিউত্তরে সে বলল,


-হুম, আমাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর। 


ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে আরাভ মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুমঘুম চোখে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। হায়তো ছেলে আর বউকে দেখতে না পেয়ে তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে। আরাভকে দেখে অভি আরাভকে জড়িয়ে ধরে বলে, জানো পাপা গ্রাম কত সুন্দর। আচ্ছা পাপা আমরা এখানেই থেকে যায় না। ছেলের কথা শুনে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর তাকে কোলে তুলে নিয়ে রওনা দিলো অন্দরমহলের দিকে।


আগামি কাল ভূমির বাবা তার চাকরি থেকে অবসর গ্রহন করবেন। তাই স্কুলের পক্ষ থেকে একটা ছোটখাটো অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়েছে। ভূমির বাবা চায় তার কর্ম জিবনের শেষ দিনের সাক্ষী হয়ে থাকুক তার আপনজনেরা। তাই তিনি ভূমিদের এখানে ডেকেছেন।


পরেরদিন সবাই সকাল সকাল তাদের গ্রামের সেই ছো্ট্ট স্কুলে উপস্থিত হোন। মাঠে পেন্ডেল করে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে স্কুলের মাঠ। স্কুলের চারদিকে লাইটিং করা হয়েছে।সামর্থের মধ্যে বেশ ভাল করে সাজিয়েছে তারা স্কুলটিকে। একে একে অতিথি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হয় প্যান্ডেলের ভিতর। এত বছর পর স্কুলের আঙিনায় পা রাখতেই ভূমি অনুভব করে তার ছেলেবেলা। মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই সোনালি দিনের স্মৃতি। দু চোখ বন্ধ করে সেই সোনালি দিনের স্মৃতি মনে করতে থাকে সে। মনে মনে ভাবে ইশ,আবার যদি ফিরে পেতাম সেই ছেলেবেলা। আরভ বুঝতে পারে ভূমির অনুভূতিগুলো। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভূমির দিকে।


চোখ মেলে সামনে তাকাতে বড়োসড়ো একটা ঝটকায় ভূমি। কে কাকে দেখছে সে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ভূমির। দুহাতে চোখ কচলিয়ে আবার সামনে তাকায় সে। না তার চোখের ভুল নয় সে সত্যিই দেখছে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব।

#বেলা_শেষে। [৩১]


ভূমিকে এমন ভাবে সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভূমির দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায় আরাভ। সামনে তাকাতেই আরাভ ও বড়সড় এক ঝটকা খায়। ততক্ষণাৎ আরাভও ঠাউর করতে পারে না। আসলে এটা সে ঠিক দেখছে নাকি চোখের ভুল। অসহায় ফেস করে ভূমির দিকে তাকায় সে। ভূমিও আরাভের দিকে তাকায়। তাদের দু-জনের মনে এটাই প্রশ্ন,


-আমি যা দেখছি তুমিও কি তাই দেখছো।


দুজনেই মাথা নাড়ায়। তাদের উত্তর তারা পেয়ে গেছে।ভূমি অস্ফুটভাবে বলে, মিমিআপু,,, ততক্ষণে আরাভ ভূমির পাশে এসে দাঁড়ায়। আরাভ ভূমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,


-এটা দিগন্তের ওয়াইফ না। ওনার এই অবস্থা কেন?? আর দিগন্তই বা কোথায়?? 


-আমিও সেটাই ভাবছি। তবে কি আমরা যেটা দেখছি সেটাই ঠিক। দিগন্ত,,, আরাভের দিকে তাকালো ভূমি। 


ভূমি আর আরাভের থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে দাড়িয়ে আছে মিমি। পড়নে সাদা কালারের শাড়ি। মাথার চুলগুলো খোপা করে রাখা আছে তার। হাতের কয়েকটুকরা কাগজ। একদম খাটি বাঙালি মেয়ের মতোই লাগছে তাকে। কিন্তু মিমির মতো এত অত্যাধুনিক মেয়ে এরকম সাধারণ জিবন যাপন করছে কেন?? ভালোবাসা কি মানুষকে এততাই বদলে দেয়। দিগন্তকে ভালোবেসে শহর ছেড়ে গ্রামে এসে গ্রামের আর পাচটা মেয়ের মতো সাধারণ ভাবে জিবন যাপন করছে সে।কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর কয়েকজন ছেলেমেয়ে আসলো মিমির কাছে।তারা হয়তো এই স্কুলের ই শিক্ষার্থী । সে ছেলেমের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। হয়তো তাদের কোন কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে সে। তাদের সাথে কথা বলার সময় মিমি হাত দিয়ে এদিক ওদিক ইশারা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কিন্ত এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিমির এত কিসের ভাব। সে কি বলছে তাদের। আর দিগন্ত সে কোথায়?? চেয়ারম্যানকে ও দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভূমির মাথায়। আরাভ ভূমিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,


-আমরা কিন্ত দিগন্তের ওয়াইফের সাথে কথা বলতেই পারি। আরাভের কথা শুনে ভূমি ভ্রু কুচকিয়ে ওর দিকে তাকালো। এসব কি বলছে আরাভ। শেষে কিনা প্রাক্তন স্বামির বউয়ের সাথে কথা বলবে।


-তোমার মাথা ঠিক আছে আরাভ। আমি এখন ওদের সাথে যাব কথা বলতে।


-প্রবলেম কি তাতে। আমি আছি তো তোমার সাথে। তোমার সম্মান রাখার দায়িত্ব আমার। আমার দেহে প্রান থাকতে তোমার সম্মানের উপর এতটুকুও আঁচ আসতে দিবো না আমি। আরাভের কথা শুনে ভূমি ছলছল নয়নে তার দিকে তাকালো। এই মানুষটার একটা কথায় ভরসা পায় সে।আমি আছি তো তোমার সাথে।এই থেকে ভরসার পাওয়ার মতো কথা আর কি হতে পারে।


-এভাবে কি দেখছেন, মেডাম?? আরাভের দুষ্টমি ভরা কন্ঠে মৃদু হাসলো ভূমি। সে তার দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। ততক্ষণে মিমি সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। আরাভ ভূমি দুজনে এদিক ওদিক মিমিকে খুঁজতে লাগলো কিন্ত কোথাও পেল না তাকে। তাই ব্যর্থ মন নিয়ে তাদের সিট গ্রহন করলো। আরাভ অভিকে কোলে নিয়ে বসে বসে অনুষ্টান দেখতে মনোযোগ হলো।


কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্টান শুরু হয়ে তারপর একে একে সঙ্গিত নৃত্য সবই হয়। বিদায়ী স্যারকে নিয়ে বক্তব্য দেয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তারপর কয়েকজন শিক্ষার্থী। এবার যে স্যারকে নিয়ে বক্তব্য রাখবে তার নামটা শুনে আরাভ ও ভুমি দুজনেই অবাক হয়। স্টেজে যখনি এনাউজমেন্ট করা হয়, এবার বিদায়ী স্যারকে নিয়ে বক্তব্য রাখতে আসছেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা মিসেস মিমি তালুকদার। মিমি তালুকদারের নাম শুনে বেশ অবাক হয় আরাভ ভূমি। মিমি এই স্কুলে শিক্ষকতা করে। কিন্ত কেন??দিগন্ত এত ভালো চাকরি করে তারপর সে একজন, দিগন্ত কোথায়? না কিছুই ভাবতে পারছে না ভূমি।  


সেদিন কোন রকমে কেটে যায়। মিমির কথা দুজনেই প্রায় ভূলে যায়। পরের দিন সকালে আরাভকে নিয়ে ভূমি ওর ছোট চাচার বাড়িতে যায়। ভূমির ছোট চাচার মেয়ের বিয়ের পাকা কথা চলছিলো সেদিন। ভূমিকে দেখে ভূমির চাচি প্রথমে খুশি হলেও পরে বিরক্ত হলো। এই ভূমি না জানি তার মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দেয়। ভূমির যে স্বভাব, একটু এদিক ওদিক হলে দিবেবিয়েটা ভেঙে। বেশ ভয় লাগছে ভূমির ছোট চাচির। তীরে এসে আবারও নৌকা না ডুবে যায়। মনে মনে সে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় তার মেয়েটার বিয়ে যেন ভালোভাবে হয়ে যায়। কে জানতো ভূমির চাচির ভয়টাই সত্যি হয়ে উঠবে।


বিয়ের পাকা কথা চলছিলো এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় ভূমি। এতক্ষণ তার ছোট চাচি তাকে আটকিয়ে রেখেছিল। যাতে ভূমি এদিকে না আসতে পারে। কিন্ত কতক্ষণ আর আটকিয়ে রাখবে তাকে।ভূমি তার চাচিকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে উপস্থিত হয় এখানে।ভূমিকে দেখে তার ছোট চাচা হাসি মুখে মেহমানদের সাথে ভূমির পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর ভূমি তার ছোট চাচার পাশে বসে তাদের কথা শুনতে থাকে।


বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক ঠাক। বরপক্ষের তেমন কোন দাবি নেই। তারা বলেছে, আপনাদের মেয়ে এক্কেবারে খালি হাতে কিভাবে দিবেন। বুঝেন ই সমাজে আমাদের একটা সম্মান আছে। সবাই যখন জিগ্যেস করবে মেয়ের সাথে কি কি দিলো। তখন আমরা কি বলবো তাদের। ভূমির চাচা তাদের কথা মেনে নেয়। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা মেয়েকে সাজিয়ে দিবে।ব্যস্ হলে গেলো এবার বরপক্ষের আরাকে দাবি,


-শুধু মেয়েকেই দিবেন? জামাইকে কিছু দিবেন না। আপনাদের বাড়ির জামাই এক্কেবারে খালি হাতে কি করে দিবেন। আমাদের ছেলের একটা বাইকে সখ। আপনারা একটা বাইক দিবেন। মেয়ে মেয়ের জামাই বাইকে করে আপনার বাড়িতে আসবে। আসে পাশে সবাই দেখবে।শুধু কি তাই। আজকাল গাড়ি ভাড়াটাও বেড়ে যাচ্ছে। বাইক হলে তো গাড়ি ভাড়ার টাকাটা বেচে গেলো।


বরপক্ষের কথা শুনে ভূমির ছোট চাচার মন খারাপ হয়ে গেলো। পন নিবে না তাও তাদের এত দাবি। কিন্ত কি করার, সর্বস্ব দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিবে। মেয়ের সুখের জন্যে এইটুকু করতেই পারে সে। সে কিছু বলবে তার আগেই ভূমি বলে উঠলো,


-আপনাদের ছেলের কেমন বাইক পছন্দ?? 


-suzuki, আব্বা বলেন suzuki হলেই হবে। পাত্র বলে উঠো। পাত্রের কথা শুনে ভূৃমি বিরবির করে বলল,


-সব ঠিক ঠাক করেই মাঠে নেমেছে দেখছি। দাঁড়াও নেওয়াচ্ছি তোমাদের বাইক।


-এই যে চাচা শুনুন, বলছি ছেলের শ্বাশুড়ি বাড়ি থেকে বাইক দিবো তাতে আপনার কোন বিনিফিট দেখছিনা। suzuki তে তো দুটো সিট। ছেলে আর ছেলের বউই বসতে পারবে। আপনি তো পারবেন না। ভেরী স্যাড। চাচা বলছিলাম কি, আমার কাছে না একটা দুর্দান্ত আইডিয়া আছে।বাইকের পরিবর্তে রিক্সা দিলে কেমন হয়। ছেলে ছেলের বউয়ের সাথে আপনিও চড়তে পারবেন তাতে। আপনার ছেলে রিক্সা চালাবে আর আপনি ছেলের বউকে নিয়ে রিক্সার পিছনে বসে বসে ঘুরবেন আর গান গাইবেন, এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো বলোতো। আপনার গ্রাম বাসিরা দেখে বাহবা দিতো। কথাগুলো বলে ইনোসেন্ট মার্কা হাসি দিলো ভূমি। ভূমির সাথে সাথে হেসে উঠলো, আরাভ। আর এদিকে, বরপক্ষ তো রেগে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করেছে। বরের বাবা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,


-বাড়িতে ডেকে এভাবে অপমান করছেন আমাদের। হবে না এই বিয়ে, এমন ছোটলোক বাড়িতে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিব না। চলো সবাই। তারপর এক এক করে সবাই চলে যায়। সবার চলে যাওয়ার পর ভূমির ছোট চাচী একটু মন খারাপ করে কারণ সম্বন্ধটা ভালো ছিল। ছেলে সরকারি চাকরি করতো। আজকাল এমন সমন্ধ পাওয়া বেশ কঠিন আর সেখানে তারা পেয়েও হাতছাড়া করল। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় ভূমির ছোটচাচার কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ তার মেয়ে রাজি নয় এই বিয়েতে। হাদিয়া নামে পন চায় এমন বাড়ির বউ হতে চায় না সে।


ভূমি যখন আরাব কে নিয়ে তার ছোট চাচার বাড়ি থেকে ফিরছিল তখন পথিমধ্যে ওদের সাথে দেখা হয় অদিতির। এতদিন পর ভূমি কে দেখে অদিতি জড়িয়ে ধরে। অদিতিকে এতদিন পর দেখে ভূমিও আবেগপ্লুত হয়ে যায়।


-ভাবি প্লিজ বাড়ি ফিরে চল। বড় চাচার খুব অসুখ। ডাক্তার বলেছে বড় চাচা বেশি দিন আর বাঁচবো না। অদিতির কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় ভূমি। বড় চাচা মানে তো চেয়ারম্যান। অদিতি তাকেই বড় চাচা বলে ডাকে। ভূমি উত্তেজিত হয়ে বলল, 


-কি হয়েছে চেয়ারম্যানের??  


-বাড়ি ফিরে চল। নিজেই দেখতে পারবে। চেয়ারম্যান বাড়ি যাওয়া নিয়ে ভূমির প্রথমে আপত্তি থাকলেও, আরাভের কথায় ও বাড়ি যেতে রাজি হয় সে। কিন্তুু সেই বাড়িতে গিয়ে এমন একটা দৃশ্য দেখবে সেটা কল্পনার বাইরে ছিলো তার।

#বেলা_শেষে। [৩২]


তালুকদার বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় আরাভ ভূমি। বসার ঘরের মিমিকে দেখে বড়োসড়ো শক খায় দুজনেই। কাল মিমিকে দেখে ভেবেছিল, দিগন্তের ভালোবাসায় নিজেকে বদলে ফেলেছে সে। হ্যাঁ মিমির জিবন বদলে গেছে তবে সেটা মিমি বদলায় নি। বদলিয়েছে দিগন্ত। দুজনেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মিমির দিকে। মিমিকে দেখে খুব খারাপ লাগছে ওদের। সাদা থান পরে খোলা চুলে ছেলেকে খাওয়াচ্ছিল মিমি। মিমির ছেলেটা অনেক বড় হয়েগেছে।ওদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে অদিতি বলে উঠল,


-কিগো তোমরা এভাবে দাড়িয়া রইলা কেন?? ভিতরে আহো। আরাভ আর ভূমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায় তারপর ধীরপায়ে ভিতরে যায় তারা। অদিতি ভিতরে ডুকতেই মিমিকে বলে,


-নতুন ভাবি দেখো কারে লইয়া আইছি। অদিতির গলার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় মিমি। আরাভ আর ভুমিকে দেখে চমকে উঠে সে। সে হয়তো ওদের এখানে আশা করেনি। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,


-ভূমি তুমি এখানে? কখন এলে?? মিমির কথার কোন জবাব দিলো না ভূমি। সে নির্বিকায় তাকিয়ে আছে মিমির পরনে এই সাদা থানের দিকে। অদিতি মিমির ছেলের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,


-আমাগো এইখান দিয়াই যাইতে ছিলো তাই ধরইরা নিয়া আসলাম। কিগো নতুন ভাবি কাজটা ঠিক করি নাই। বড় চাচাও তো অসুখ তারেও একটু দেইখা যাইতে পারবো। বলা তো যায়না কবে আবার মইরা যায়।


-অদিতি। একটু শক্তগলায় বলল মিমি। কি বলছো তুমি এসব। বাড়িতে অতিথি নিয়ে আসছো আর তাদের সামনে এসব কথা বলছো। তোমার সেন্স কোন দিনও হবে না। অদিতিকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে ভূমির দিকে তাকায় মিমি। অধরে হাসি ফুটিয়ে বলে,


-আরে ভূমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো। বসো না, বসো এখানে।


-মিমি আপু, তোমার গায়ে থান কেন?? অশ্রুসিক্ত নয়নে মিমির দিকে তাকিয়ে বলল ভূমি। ভূমির কথা শুনে হাসলো মিমি। তাছিল্যের হাসি হাসলো। অতঃপর সে তার থানের দিকে তাকিয়ে বলল,


-দিগন্তের দেওয়া শেষ উপহার এটা। এখন এটাই আমার বস্র।তোমরা বসো এখানে। আমি তোমাদের জন্যে চা করে আনছি। হন হন করে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় মিমি। ভূমিও ওকে আটকায় না। যাক না যদি সে সেখানে গিয়ে চোখের জল আড়াল করতে পারে তাহলে ক্ষতি কি? 


এদিকে মিমি ওদের জন্যে চা করতে যায় তখন ভূমি অদিতিকে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানের ঘরে। সেখানে গিয়ে চেয়ারম্যান ওর তার স্ত্রীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে আবার বসার ঘরে চলে আসে সে। ততক্ষণে মিমিরও চা বানানো শেষ। মিমি, আরাভ ও ভূমির হাতে চায়ের কাপ দেয়। ভূমি চায়ের কাপ রেখে মিমিকে জোড় করে ওদের পাশে বসায়। মিমি ওদের পাশে বসে মাথা নিচু করে রাখে। তখন ভূমি বলে উঠে,


-মিমি আপু কি হয়েছে দিগন্তের? কোথায় সে?? তুমি সাদা থান কেন পরে আছো?? আর চেয়ারম্যান কাকা তো তোমাদের মেনে নেয়নি তাহলে তোমরা গ্রামে আসলে কি করে?? ভূমির করা প্রতিটা প্রশ্ন মিমির মনে ঝড় বয়ে দিচ্ছিলো। সেই ঝড়ে ধুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিলো মিমিকে। তবুও নিজেকে সামলে নিলো সে। এখন আর কোন ঝড় মিমিকে ভাঙতে পারে না। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সমলে নিতে শিখে গেছে সে। দু-চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নিলো সে তারপর মিমি ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে অদিতিকে বলে, 


-অনন্তকে নিয়ে ঘরে যাও অদিতি। মিমির কথার দ্বিরোক্তি করে না অদিতি। সে মিমির ছেলে অনন্তকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। অদিতির চলে যাওয়ার পর ভূমি মিমির হাত দুটি শক্তকরে ধরে বলে,


-চেয়ারম্যান চাচা তোমাদের মেনে নিয়েছে?? 


-হ্যাঁ তিনি আমাদের মেনে নিয়েছেন। বিয়ের এক বছর পর্যন্ত তিনি আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করেন নি। আমরা যোগাযোগ করতে চাইলে সে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্ত একবছর পর যখন আমাদের কোল আলো করে অনন্ত আসে তখন বাবা আর রাগ করে থাকতে পারেন না। আমাকে মেনে নেন তিনি। বাবা কি বলে জানো, যখন কোন গাছে পোকা ধরে তখন মানুষ সেই পোকাটাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে, গাছকে নয়। আমরা ভুল করেছি তাই তিনি আমাদের দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের এক্কেবারে দূরে ঠেলে দিন নি। তারপর থেকেই আমাদের গ্রামে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। দিগন্ত আণবিক সংস্থায় চাকরি করতো আর আমি আমাদের ছো্ট্ট সংসারটাকে সামলে রাখতাম। অনন্তকে নিয়েই দিন কেটে যেত আমার।বাবা মা মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। অনন্তকে দেখে আবার চলে যেতেন। একদম সুখী পরিবারে পরিনিত ছিলাম আমরা। কিন্তু আমাদের পরিবারেই এই সুখ বেশী দিন টিকলো না। কথাগুলো বলেই চোখ থেকে দু-ফোটা জল ফেলল মিমি।


-কি হয়েছিল দিগন্তের। প্রশ্ন করলো আরাভ।


-ভূমির উপর যখন দ্বিতীয়বার এ্যটাক হয় মনে আছে সেই দিন কলেজ থেকে কিছুটা দূরে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আসলে সেটা এক্সিডেন্ট কোন এক্সিডেন্ট ছিলো না। জেনে বুঝে এক্সিডেন্টটা করানো হয়েছিল। আর এটা করেছিল মাহিন। আসলে সেদিন যে মাহিন সদলবল নিয়ে ভূমির উপর এট্যাক করবে সেটা জেনে গিয়েছিল দিগন্ত। আসলে সেদিন ছিলো দিগন্তের অফ ডে। তাই আমরা আমাদের ছেলেটাকে নিয়ে একটু বাহিরে গিয়েছিলাম। সারাদিন রুমে বসে থাকতে থাকতে আমরা মা আর ছেলে দুজনেই বোরিং হয়ে গিয়েছিলাম। তাই দিগন্ত সেদিন আমাদের নিয়ে আমাদের একটু বেড়াতে গিয়েছিলো। তখন পথিমধ্যে শাওন আমাদের মাহিনের এই ব্যপারটা বলে, শাওনের কাছ থেকে সব শুনে দিগন্ত আমাদের বাড়িতে রেখে মাহিনের কাছে যায়। সে মাহিনকে অনেক বুঝাতে থাকে যাতে এই রকম পাপ কর্ম সে না করে। কিন্ত মাহিন দিগন্তের কোন কথাই কানে তুলে না। উল্টে সে দিগন্তকে থ্রেড দিতে থাকে। দিগন্ত যদি ওদের বাধা দেয় তাহলে সে দিগন্তের প্রাণ নিয়ে নিবে। দিগন্ত থেমে থাকে না। সে মাহিনের সাথে লড়াই করে। মাহিন লড়াই করার সময়ই তার এক চামচাকে দিয়ে দিগন্তের বাইকের একটা তার ছিঁড়ে রাখে। মাহিনের সাথে ছিলো ওর চমচারা ছিলো। আর দিগন্ত ছিলো একা। তাই সেদিন দিগন্ত মাহিনের সাথে পেরে উঠে নি।মাহিন দিগন্তকে মেরে আধমরা করে রেখে চলে যায়। দিগন্ত ওই অবস্থাতে বাইক চালাতে থাকে। তখন ওর উদ্দেশ্য ছিলো ভূমিকে ইনফ্রোম করা। একদিকে রক্তাক্ত শরীর আর অন্যদিকে বাইকের একটা তার ছেড়া। কন্ট্রোল করতে পারছিলো না সে তার বাইককে। সামনে থেকে একটা ট্রাক এসে দিগন্তের বাইক ধাক্কা দিয়ে দূরে ছিটকে দেয়। যার ফলে সেদিন প্রান হারায় দিগন্ত। কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই কেঁদে ফেলল মিমি। এবার ভূমিও কাঁদছে। দিগন্ত তার জন্যে প্রান দিলো। দিগন্তের মৃত্যর জন্যে দায়ি ভূমি। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ভূমির। ওর কারনে একটা সুখের পরিবার মুহূর্তেই ভেঙে চুড়মার হয়ে গেলো। মিমি তার চোখের পানি মুছে আবারও বলল,


-সেদিন দিগন্তের লাশ নিয়ে আমরা গ্রামে চলে আসি।দিগন্তকে এই অবস্থায় দেখে ব্রেন স্টোক করে বাবা। সেদিন থেকে বাবা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছে। আমাও ও আর শহরে ফিরে যাওয়া হয়নি। আমার বাবা আমাকে বলেছিল, সব ভূলে নিজের জিবনটাকে নতুন করে শুরু করতে। কিন্ত আমি তাকে বুঝাতে পারিনি, দিগন্তকে ছাড়া নতুন জিবন শুরু করতে পারবো না। দিগন্ত না থেকে সর্বক্ষণ আমার সাথে আছে। ও তো আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে। আমি কি করে ওর জায়গায় অন্যকাওকে বসাবো। আমার বাবাও আমাকে ভুল বুঝে। তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। দিগন্ত চলে যাওয়ার আগে আমাকে একটা পরিবার দিয়ে গেছে। ও একটা উপহার দিয়েছে আমাকে যেটা আঁকড়ে ধরে আমি সারাজিবন কটিয়ে দিতে পারবো। তারপর থেকে এই পরিবারই আমার সব। সংসারের হাল ধরি। নতুন করে সব শুরু করি। এলাকার স্কুলে আমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন দিগন্তের ছোট চাচা। ভূমি, জানো আমি খুব খুশি। তুমি মাহিনকে শাস্তি দিয়েছো এটা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। 


ভূমি এবার আর নিজেকে আটকি কেঁদে দিলো সে। আরাভ ভূমিকে তার বুকে জড়িয়ে নিলো। ভূমি দিগন্তের বুকে মাথা রেখে কান্নারত অবস্থায় বলতে লাগলো,


-আমার জন্যে দিগন্তের প্রান চলে গিয়েছে। ছোট্ট অনন্ত ওর বাবাকে হারিয়েছে। বাবার আদর ভালোবাস কি হয় সেটা বুঝার আগেই বাবাকে হারিয়েছে সে। মিমি আপু তার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে। ভালোবাসার মানুষটাকে হাড়ানোর কষ্টটা আমি জানি আরাভ। দুই বছর তোমাকে ছেড়ে থেকেছি। কতটা যন্ত্রনা হয় সে আমি বুঝে গেছে। আর সেখানে মিমিআপু তিন বছর ধরে তার ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে বেচে আছে।তার কতটা কষ্ট হচ্ছে। তার এই কষ্টের জন্যে শুধুমাত্র আমি দায়ী।আরাভ তুমি কেন সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো বলো। আমি যদি সেদিন মরে যেতাম তাহলে এতকিছু হতো না। আমার বেচে থাকার কোন অধীকার নেই।


ভূমির বলা প্রতিটা কথা আরাভের বুকে বিষাক্ত তীরের মতো লাগছে। ভূমি নিজের মৃত্য কামনা করছে। এই কথাটা শুনার আগে তার মরন হলো না কেন?? আরভ শক্তকরে ভূমিকে তার বুকে চেপে ধরে। এদিকে আরাভ আর ভূমিকে দেখে মিমির অধরে হাসি ফুটে উঠলো। দু-জন ভালোবাসার মানুষকে একসাথে দেখতে ঠিক কতটা সুন্দর লাগে বলে বুঝাতে পারবো না। মিমি আনমনে বলে ফেলল,


-দিগন্ত, আমি জানি তুমি সবসময় আমার সাথে আছো।তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে সব সময় আমার পাশে থাকবে। আমাকে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে, তাহলে, আমাকে একা ফেলে চলে কেন গেলে। আমার খুব কষ্ট হয় জানো। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। কেন আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেলে।

#বেলা_শেষে চলে গিয়ে ছায়া রেখে গেলে। তোমার ছায়াটা আঁকড়ে ধরেই এখনো শ্বাস নিচ্ছি আমি।

#বেলা_শেষে। [৩৩]


গ্রাম থেকে চলে এসেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো। আরাভ এখন তার অফিস নিয়ে ভিষন ব্যস্থ হয়ে পরেছে।ভূমি সারাক্ষণ বাসায় থাকে। বাড়ির কাজ কর্ম করে আর বাকিটা সময় অভিকে নিয়ে কটিয়ে দেয়। ভূমির সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকা নিয়ে বেশ ভাবাচ্ছে আরাভকে। ভূমি কেন তার অফিসে যায়। এই নিয়ে আরাভ তাকে অনেক প্রশ্ন করলেও প্রতিবারই এড়িয়ে যাচ্ছে ভূমি। কোন না কোন বাহানা দিয়ে কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে সে। আজ সকাল সকাল আরাভ অফিসে চলে যায়। সকালে ঠিকমতো ব্রেকফাস্ট ও করে নি সে। এই নিয়ে ভূমি কিছু জিগ্যেস করলেও কোন জবাব দেয়না আরাভ। একরকম ভূমিকে ইগনোর করে চলে যায় সে। আরাভ চলে যাওয়ায় পরে ভূমি অভিকে নিয়ে স্কুলে চলে যায়। খন্দকার আদনান মাহবুব তার স্ত্রীরে নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। এই বয়সে এসে জুবাইদার মনের সব আশা পূরন করতে ব্যস্ত সে। সারাজিবন বইয়ের পাতায় মুখ গুজে রেখে এখন গেছে বউকে নিয়ে বেড়াতপ। আজহার মওদুদের শরীরটা খুব ভালো নয়। সারাক্ষণ তার রুমেই থাকে। ভূমি গিয়ে সময় মতো তার খাবার আর ঔষুদগুলো দিয়ে আসে।


বিকাল বেলায় নয়না মিষ্টিকে নিয়ে আসে খন্দকার ভিলায়। অভি ড্রয়িংরুমে বসে একা একা বল নিয়ে খেলছিলো। এমন সময় নয়না আর মিষ্টির প্রবেশ। অভি নয়নাকে দেখে খুশি হলেও মিষ্টিকে দেখে খুব রাগ হয় অভির। সে বলটাকে মিষ্টির মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারে। কিন্তু অভির ব্যার্থ হয়। তার আগেই মিষ্টি দৌড়ে এসে ভুমির কোলে উঠে। এবার অভির রাগ আকাশ ছোঁয়া। তাকে তার দেখে কে।রাগে কটমট করতে করতে সেখান থেকে চলে যায়।ভূমি মিষ্টিকে কোলে নিয়ে সুফায় বসে। নয়নাও তার পাশে বসে। তারপর দুজনে গল্প করতে শুরু করে।


রাতের বেলা আরাভ রাকিবকে নিয়ে বাসায় ফিরে। ভূমি আগেই ওদের জন্যে রান্না করে রাখছিলো। আরাভ বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে অভিকে কোলে নিয়ে সোজা ড্রাইনিং টেবিলে বসে। তারপর রাকিবকে নিয়ে এক সাথে খেতে বসে সে। ভূমি খাবার পরিবেশ করছে। কিন্ত আশ্চর্য বিষয় আরাভ ভূমির সাথে একটা কথাও বলছে না। নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে সে। ভূমি কিছু জিগ্যেস করলে তার জবাব ও দিচ্ছে না। ব্যপারটা ভূমির কাছে খুব খারাপ লাগে। ভূমির ইচ্ছে করছে ফল কাটার ছুড়িটা নিয়ে আরাভের গলায় ধরতে। আর ছিনতাই কারির মতো বলতে, কথা বল, কথা না বললে,তোর গলাটা কেটে দিবো। কিন্তুু এই মুহূর্তে সে এটা কিছুতেই করতে পারবে না। তার ভালো মেয়ের মতো চুপ করে সবটা সহ্য করে নেয়। ওদের খাওয়া শেষ হলে আরাভ আর রাকিব দুজনেই সুফায় বলে গল্প করতে শুরু করে দেয়। এদিকে ভূমি অপেক্ষা করতে থাকে সে কখন আরাভকে একা পাবে। আরাভের ইগনোর সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। প্রিয় মানুষের অবহেলা সত্যিই খুব যন্ত্রনাদায়ক। কেও মেনে নিতে পারে আবার কেও মানতে পারে না। যারা মানতে পারে না তারা কেও কেও আবেগের বসে নিজর জিবনটাই ধংশ করে দেয়। কিন্ত ভূমি শক্ত মানব। জিবনের সাথে লড়াই করেই বেচে আছে। তার ধারনা সমস্যার মোকাবেলা না হলে সমস্যাটা আরো জটিল হতে থাকে। তাই সে কোন সমস্যার আগে মোকাবেলা করতে হবে।তারপর ভাবতে হলে কি করে সেই সমস্যার সমাধান করা যায়। সমস্যা থেকে দূরে পালিয়ে থাকলে সেটা আরো জটিল থেকে জটিল হতে থাকে।


রাতের দশটার দিকে বাড়ি ফিরে যায় নয়না আর রাকিব। ভূমি অভিকে ঘুম পারিয়ে ওর পাশেই শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। আরাভ রুমে গিয়ে বিছানায়র দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে লেপটপ নিয়ে বসে পরে। রুমে আরাভের অবস্থা টের পেয়ে চোখ খুলে ভূমি। আরাভকে বিছানার এক পাশে লেপটপ এ মাথা গুজে থাকতে দেখে ভূমি উঠে বসে। তারপর সে আরাভে পাশে গিয়ে লেপটপটা বন্ধকরে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। আরাভ ভূমির দিকে তাকিয়ে বলে,


-প্রবলেম কি তোমার?? 


-প্রবলেম আমার নয়। প্রবলেম হচ্ছে তোমার। আমাকে ইগনোর কেন করছো?? 


-লেপটপটা দেও। কাজ করছি আমি।


-আগে আমার জবাব চাই। বলো কেন ইগনোর করছো আমাকে।


আরাভ ভূমির কথার কোন জবাব দেয় না। সে উঠে সোজা বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় দাড়িয়ে রেলিং এর উপর হাত রেখে বাহিরে দিকে তাকিয়ে থাকে সে। অন্ধকারে মুড়িয়ে থাকা শরটাকে দেখে মনে হয় যে গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে আছে। আজকে অন্ধকার একটু বেশীই পরেছে। দুরে ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভূমি এসে আরাভকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা রাখলো। এতে মনে হয় আরাভে হৃদস্পন্দন হাজার গুনে বেড়ে যাচ্ছে।


-আমার সাথে কেন কথা বলছো না তুমি?? তুমি জানো না তোমার ইগনোর আমি মেনে নিতে পারি না।


আরাভ কোন কথাই বলল না। সে আগের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো। অতঃপর ভূমি আবারও বলল,


-আমার কোন কাজে তুমি কষ্ট পেলে থাকলে প্লিজ বলো আমাকে। আমি সেটা শুধরে নিবো। কিন্তু তুমি চুপ করে থেকো না আরাভ।


আরাভ এবার কোন কথা না বলে ভূমিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভূমিকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,


-আমার সব কথাই শুনবে তুমি।


-হ্যাঁ শুনবো। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। প্লিজ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। এমনিতেই সবার চোখে অপরাধী আমি। তুমি আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দাও। কিন্তু আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। 


ভূমির শেষ বাক্যটা আরাভের বুকে লাগলো। কেমন যেন চিন চিন ব্যথা শুরু হলো সেখান থেকে। সে দ্রুত ভূমির কাদে হাত রেখে বলল,


-কেন নিজেকে অপরাধী মনে করছো। তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে তোমার কোন হাত নেই। ভূমি, তোমার উপর আমার কোন রাগ অভিমান কিছুই নেই। তুমি ভাবলে কি করে আমি তেমার সাথে রাগ করবো। সারাদিন যতই কাজ করিনা কেন? অফির কাজের চাপে যখন মন খারাপ হোক না কেন? #বেলা_শেষে বাড়ি ফিরে তোমার হাসি মুখখানা দেখলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। আমার ভালো থাকার মহা ঔষুদ তুমি।আর আমি তোমাকে কি শাস্তি দিবো বল।আমার শুধু একটা কথাই জানতে চাই, তোমার অফিস, নিয়ে কথা বললে ইগনোর কেন করো। সেখানে কোন ঝামেলা হয়েছে কি? বলো আমাকে। 


-আরাভের কথা শুনে চুপসে যায় ভূমি। আরাভ এই কারনে তার সাথে রেগে আছে। 


-এই কারনে তুমি রেগে আছো আমার উপর। করুন চোখে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমি।


-কারনটা আমি জানতে চাই ভূমি। প্লিজ চুপ করে থেকো না। স্পিক আপ। ভূমি প্লিজ বলো আমাকে কি হয়েছে। চুপ করে থাকলে কোন সমস্যার সমাধান হয় না। বলো আমাকে।


-এটার সমাধান তুমি করতে পারবে না আরাভ। মাথা নিচু করে বলল ভূমি। আমি আর কোন দিন লো-ইয়ার হিসাবে কাজ করতে পারবো না আরাভ। আমার ক্যারিয়ার নস্ট হয়ে গেছে।


ভূমির কথা শুনে আরাভের হাত আলগা হয়ে আসলো। ও ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলো মনে মনে। তার কানের কাছে এখনো একটা কথাই বাঝছে, আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে।


-কি করে হলো এসব।


আরাভের প্রশ্নে শুনে ভূমি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকায়। অতঃপর বলতে শুরু করে, একদিনের জন্যে বিচারপতি হয়ে আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারটাই শেষ করে দিয়েছি। মাহিনকে কোর্টে উঠানোর পর আমি প্রথমে একজন আইনজীবি হিসাবে যোগ দেই। ওর সমস্ত কু কর্মের প্রমান জোগাড় করি আমি। কিন্ত তাতেও আমার শান্তি হচ্ছিল না। ওর ফাঁসির আদেশ নিজে হাতে লিখতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমি বিচারপতি নই। তাহলে কি করে মাহিনের ফাঁসির আদেশ লিখবো আমি। 


বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবী ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্যে সত্যিকার যোগ্য ব্যক্তি নির্ধারণে প্রধান বিচারপতি মুখ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মত দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া এক রায়ে এমন মত এসেছে। সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদ তুলে ধরে যোগ্যতার বিষয়ে সাত দফা পর্যবেক্ষণসহ হাইকোর্টের দেওয়া ৪৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ একটি রায় প্রকাশিত হয়। 


রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে একজন ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ হওয়া উচিত। বিচারকদের ক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারিক অভিজ্ঞতা তিন বছরের কম হলে উচ্চতর বিচারিক ক্ষেত্রে তাঁরা সুপারিশের জন্য গণ্য হবেন।


এর কোনটাই আমার ছিলো না। আমি কিছুতেই বিচারপতির আসনে বসতে পারছিলাম না। তাই আমি বিচারপতি জিয়াউর হায়দারের সাথে কথা বলি। আর তিনি আমাকে একটা শর্ত দেন। আমি দ্বিধায় পরে যাই। কি করবো। একদিকে আমার স্বপ্ন,আমার ক্যারিয়ার আর অন্যদিকে মাহিনের ফাঁসির রায় লেখার ইচ্ছে। কোনটা নেওয়া উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না। পর ভাবলাম, আইনজীবি হতে চেয়েছিলাম অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্যে। মাহিনের চেয়ে বড় অপরাধী আর কে হতে পারে বল আমাকে। যে মেদের সম্মান নষ্ট করে। আমাদের দু দুবার ধর্ষণ করতে চেয়েছে। তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো তার শাস্তি আমি নিজের হাতে লেখতে পারবো না। এটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। পরে যা হবে দেখা যাবে। আমি শর্তটা মেনে নেই। আর একদিনের বিচারপতি হয়ে আমার স্বপ্ন বিসর্জন দেই। আরাভ আমি জানি আবেগের বসে আমি ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।কি করবো বলো, দু-চোখ বন্ধ করলেই তোমার সেই রক্তাক্ত শরীরটা ভেসে উঠতো। আরাভ প্লিজ আমাকে ভূল বুঝো না তুমি। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো ভূমি। আরাভ ভূমিকে নিজের বুকে জড়িয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,


-প্লিজ কেদো না জান। তোমার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এই সিদ্ধান্ত টাই নিতাম। প্লিজ কেঁদো না। আমি বিচারপতি জিয়াউর হায়দারের সাথে কথা বলবো। ওনি কেন তোমাকে এমন শর্ত দিলো। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে ক্যারিয়ার তোমাকে ফিরিয়ে দিবো আমি।


ভূমি আরাভকে দুহাতে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো। আরাভও তার প্রিয়সিকে তার বুকে আগলে রাখলো।

#বেলা_শেষে।


[অন্তিম পর্ব]


সূর্যের রশ্নি এসে ঘুমন্ত ভূমির মুখে পড়তেই চোখ পিটপিট করে ভূমি। সূর্যের তেজ খুব বেশী না হলেও ভূমির ঘুম ভাঙার জন্যে যথেষ্ট। পিটপিট করে আখি মেলে সামনে তাকাতেই আরাভের হাসিমাখা মুখ দেখতে পায় সে। আরাভ অধরে হাসি ঝুলিয়ে ভূমির দিকে ঝুকে বসে আছে। 


-শুভ মর্নিং জানপাখি। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল আরাভ।


-গুভ মর্নিং। শোয়া থেকে উঠে বসলো ভূমি। অতঃপর সে আরাভকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো,


-আজ অফিস নাই তোমার। তারপর সে পাশে তাকালো কিন্ত অভি সেখানে ছিলো না। অভি কোথায় আরাভ। রাতে তো আমার পাশেই ছিলো তাহলে এখন কোথায় গেলো?? 


ভূমির করা প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না আরাভ। সে ভূমিকে বিছানা থেকে টেনে তুলে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। এদিকে ভূমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে হাই তুলছে বারবার। তখনি আরাভ হাতে একটা শুভ্ররাঙা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। সে ভূমিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,


-এখনো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো। তারপর আরাভ নিজেই ভূমির ব্রাশে পেষ্ট ভরিয়ে নিলো। তারপর সে ভূমির দিকে দু-পা এগিয়ে ঠোঁঠের কোনে দুষ্ট হাসি টেনে বলল, ব্রাশটা কি আমিই করিয়ে দিবো।


ভূমি খপ করে আরাভের হাত থেকে ব্রাশ নিয়ে বলে, অসভ্য লোক একটা। ভূমি আরাভের হাত থেকে শাড়ি নিয়ে ওকে ওয়াশরুমে থেকে বের করে দেয়। 


শুভ্র শাড়ি পরে মাথায় টাওয়াল পেচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে ভূমি। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে বডি স্প্রে লাগাচ্ছিল আরাভ। আয়নার মধ্যে ভূমিকে দেখে একরকম নেশা লেগে যায় আরাভের।সাদা শাড়িতে একদম সদ্য ফুটে উঠা ফুলের মতো লাগছে ভূমিকে। হাতে থাকা বডি স্প্রে ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে ঘোর লাগালো চোখে ভূমির দিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে ধীর পায়ে ভূমির দিকে এগোতে থাকে। আরাভের এমন ধারা চাহনি দেখে অধরোষ্ঠ চেপে হাসে ভূমি।মনে মনে বলে, এই আরাভনা বড্ড পাগল।


ভূমির হাত ধরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসিয়ে দেয় আরাভ। তারপর ওর মাথা থেকে টাওয়াল খুলে আলতো হাতে ভূমির মাথার চুল মুছে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আরাভ টাওয়ালটা রেখে ভূমির চুলগুলো এক সাইডে নিয়ে কানের লতিতে গভীরভাবে চুমু খায়। এতে ভূমি কেপে উঠে শাড়ির আঁচল শক্তমুঠি করে ধরে। আরাভ ভুমিকে উঠিয়ে তার সামনে দাঁড় করায়। তারপর সে ভূমির অধরের দিকে ললাসুদৃষ্টি প্রয়োগ করে। আরাভের এমন ললাসুদৃষ্টি ভূমিকে বারবার কাপিয়ে তুলছে।ভূমি তার অধর কামড়িয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। আরাভ ভূমির দিকে এগিয়ে আসলে ভূমি পিছিয়ে যায়। আরাভ ওর দিকে এগোতে থাকে। আর ভূমি পিছনের দিকে দিকে যেতে থাকে।এক পর্যায়ে ভূমি দেয়ালের সাথে লেপ্টে যায়। আর আরাভর ওর দু-পাশে দেয়ালে হাত রেখে গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে ভূমির মুখশ্রীর দিকে। কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর আরাভ আবারও এগিয়ে যায় ভূমিকে কিছ করার জন্যে আর তখনি অভি এসে পরে রুমের ভিতরে । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরাভকে উদ্দেশ্য করে বলে,


-পাপা আই এম রেডি।চল এবার।


অভিকে রুমে দেখে চমকে উঠে দুজনেই। হঠাৎ করেই অভির আগমনে মন খরাপ হয়ে যায় আরাভের। আর আরাভের এমন ধারা মুখের রিয়্যাকশন দেখে ফ্যালফ্যাল করে হেসে দেয় ভূমি।আরাভ হাত দিয়ে মাথা চুলকিয়ে বিরবির করে বলে,


-এই ছেলের জন্যে এখন ঠিকমতো রোমান্স ও করতে পারি না। ছেলেতো নয় যেন শত্রু হয়ে জম্মেছে। আরাভের বিরবির করে বলা কথা ভূমির কানে ঠিকই পৌছালো। আরাভের কথা শুনে ভূমি ঠোঁট চেপে হেসে বলে,


-দাঁড়িয়ে আছো কেন?? তোমার ছেলে তোমাকে ডাকছে যাও। আমি এখনি রেডি হয়ে আসছি। আরাভ অসহায়ের মতো ভূমির দিকে তাকিয়ে বলে,যাচ্ছি। তারপর সে অভির কাছে গিয়ে অভির হাত ধরে বাহিরে চলে যায়। আর ভূমি তৈরী হতে থাকে। 


ড্রয়িংরুমে বসে অভিকে খাওয়াচ্ছে আরাভ। অভি ফুটবল নিয়ে পুরো ড্রয়িংরুমে খেলছে আর খাচ্ছে। এমনি সময় রাকিব তার পরিবার নিয়ে হাজির হয়। রাকিবের কোলে মিষ্টিকে দেখেই ক্রোধান্বিত হয়ে মিষ্টির দিকে তাকায় অভি। সে ফুলবলটাকে লাথি দিয়ে উল্টোদিকে দেয় । অভির ফুটবলে লাথি দেওয়া দেখে মিষ্টি রাকিবের কোল থেমে ফুটবল আনতে যায়। আর ততক্ষণে রাকিব ও নয়না আরাভের পাশে গিয়ে বসে।


মিষ্টির পিছু পিছু অভিও যায় ফুটবলের কাছে। মিষ্টি যেই না ফুলটবলে হাত দিবে অমনি অভি ফুটবলটা তুলে নেয়। আর মিষ্টির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দেয়। কারন তখন মিষ্টির মুখের অবস্থা ছিল নাজেহাল। সে জানে অভি তাকে কিছুতেই বল টা দিবে না। বাচ্চা মন এতকিছু মনে ধরে রাখার ক্ষমতা নাই তার। তাই সে আবারও বলটা ধরতে যায়। আর তখন অভি মিষ্টির মাথার ছোট ছোট ঝুটি দুইটা টান দিয়ে খুলে দেয়। মাথার ক্লিপগুলো খুলে দেয়। ক্লিপ অভির হাতে দেখে মিষ্টি আধো আধো গলায় বলে,


-আমাল কিপ দাও ভায়া।


-দিবো না। যা এখান থেকে।


মিষ্টি জোড় করে অভির হাত থেকে ক্লিপ নিতে যায় কিন্ত পারে না। তাই সে অভির হাতে কামড় বসিয়ে দিয়ে। অভির চিৎকার করে ওর হাতে থাকা রাবার ক্লিপ নিচে ফেলে দেয়। মিষ্টি সেগুলো তুলে নেয়। আর ততক্ষণ আরাভ ভূমি রাকিব ও নয়না ওদের কাছে চলে আসে। আরাভ অভির কাছে গিয়ে বলে,


-কি হয়েছে বাবা, ব্যথা লাগছে। অভির হাত নাড়াতে নাড়াতে জবাব দেয়,


-ওই জংলি বিল্লি আমাকে কামড় দিয়েছে। ও মানুষ নয় ওর একটা রাক্ষস। ওকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় দিয়ে এসো।


-তুই কি করেছিস আগে বল। তুমিও যে খুব ভালো মানুষনা সেটা আমি জানি। মিষ্টিকে কি করেছিস বল। ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্ন করলো ভূমি। অভি কিছু না বলে আরাভকে জড়িয়ে ধরলো। ভূমি মিষ্টিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,


-মামনি, ওই বাদুরটা আবার তোমাকে মেরেছে তাইনা।মিষ্টি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো। অতঃপর ভূমি আমার বলে,


-তাহলে কি করেছে। মিষ্টি ওর হাতে থাকা ক্লিপগুলো দেখিয়ে বলে,


-আমাল কিপ নিয়েথিলো। তাই কামল দিয়েতি। ভূমি ক্রোধান্বিত হয়ে অভির দিকে তাকাতেই আরাভ অভিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,


-ছেড়ে দাওনা বাচ্চা ছেলে।


-হ্যাঁ বাচ্চাই তো। তুমি ওকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো।অতি আদরে বাদর হচ্ছে দিনদিন। অভি আরাভের কোল থেকেই আড় চোখে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ওর গুষ্টির ষষ্টি উদ্ধার করতে থাকে। 


-আহ্ ভূমি কি হচ্ছে কি?? আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে চল। অতঃপর তারা সকলেই বেড়িয়ে যায়।


প্রায় চার ঘন্টা জার্নি শেষে নয়নাদের গ্রামে পৌঁছায় সবাই। ওরা আসবে বলে নয়নার মা আগে থেকে সব কিছুর বন্ধবস্ত করে রেখেছিলো। নিতু আর ইভান ও এখানে আসছে। ওদের এক বছরের একটা মেয়ে আছে। নীলাও ওর স্বামিকে নিয়ে আসছে। দুই বছর ওদের দাম্পত্য জিবন। এখন কোন সন্তানসন্ততি হয়নি।সবাইকে একসাথে দেখে বেশ অবাক হয় সকলে।তাছাড়া বাড়িটাকেও বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আজ এই বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান আছে বলে তো মনে হয়না। তাহলে বাড়িটাকে এত সুন্দরকরে কেন সাজানো হয়েছে। নয়নার কাছে বিষয়টা জানতে চাইলে নয়না জবাব দেয় আজ তার বড় ভাই দেশে ফিরছে। লেখাপড়া করার জন্যে তুরস্কে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে আর ফিরে নি। এতদিন সেখানেই থেকেছে। ওখানেই এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করছে। দুজন বাচ্চা আছে তাদের। আজ এতবছর পর ভাইয়ের মনে হয়েছে সে দেশে ফিরে আসবে। তাই এই ছোট্ট আয়োজন। আর আমাদের সকলের এখানে আসা।


বিকালের নয়নার ভাই তার পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে। তাদের দুটো সন্তান। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটার বয়স অভির বয়সের কাছাকাছি হবে। আর মেয়েটা মিষ্টির সমান। এতবছর পর ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখে খুব খুশি হয় নয়নার বাবা মা।


সন্ধাবেলায় সকলে যখন নয়নার ভাই আর তার পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত তখন ভূমি এসে দাঁড়ায় নয়নাদের উঠনে সে হাসনাহেলা ফুল গাছের কাছে। কি সুন্দর ফুলের গ্রাণ। মুহূর্তেই মনটাকে ভরিয়ে তুলে। ভূমি দুই হাত প্রসারিত করে মনটাকে উপভোগ করতে থাকে তখন আরাভ এসে সেও তার হাত প্রসারিত করে ভূমির হাতে হাত রাখে।


-একা একা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবে নাকি জানপাখি। ভূমির হাতদুটো ধরে গুটিয়ে নিয়ে ভূমিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আরাভ।


-তুমি এখানে।


-দেখতে এসেছি।


-প্রকৃতি অপরুপ।


-না। আমার মায়াবতীর রুপ দেখতে এসেছি। আমার মায়াবতী দেখবে প্রকৃতির রুপ। আর আমি দেখবো আমার মায়াবতীর রুপ। বলেই ভূমির গালে চুমু খায় আরাভ। তারপর সে ভূমির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,


-ভালোবেসেছি যখন ছাড়ছি না আর তোমাকে। তুমি শুধু আমার, দেবনা ভাগ আর অন্য কাউকে। তোমার মহিমাতে আস্তে আস্তে যাচ্ছি যে আমি পুড়ে, রেখেছি তোমায় মনের গহিনে। ওগো প্রিয়সি।


আরাভের বলা প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করার সময় ওর ঠোট স্পর্শ করেছে ভূমির কানের লতিতে। ভূমি বারবার কেপে কেপে উঠছে তাতে। ভূমি গভীর গলায় বলল, 


-আরাভ!!  


-হুম বলো।


-এভাবেই পাশে থাকবে আমার। আমাকে ভালোবাসবে। কখনো আমাকে একা করে দিবে না।


-তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতেও পারিন। আর তুমি বলছো, তোকে ছেরে যাওয়ার কথা। যদি কখনো তোমাকে একা করে চলে যাই তাহলে ভেবে নিবে এই আরাভ আর পৃথিবীতে নেই। আরাভ যতদিন আছে সে তোমার পাশেই আছে। আমার এই হাত দুটো ধরে আছে। জানপাখি তুমি জানো তুমি আমার অস্তিত্বে মিশে আছো। তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো বলো। #বেলা_শেষে আমি শুধু তোমার।


ভূমি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর সে আরাভের গলা জড়িয়ে ধরে। আরাভ দু-হাতে ভূমির কোমড় জড়িয়ে ধরে ভূমির কপালে ভালোবাসার পরশ একে দেয়। ভূমি আবেশে তার চোখ দুটি বন্ধকরে নেয়। ভূমি মনে মনে বলতে লাগে,


-আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়-মাঝে আরো কিছু নাহি চাই গো।

আমি তোমারে রেখেছি মন পাঁজরে আর কিছু নাহি চাই গো।

আমি তোমারে দেখি দু-নয়ন ভরে আর কিছু দেখি নাহি গো।

আমি তোমারে ছুয়েছি বক্ষ ছুঁয়ে আর কিছু ছুই না গো।।


সমাপ্তি।


[বিঃদ্রঃ- আসসালামু আলাইকুম, আশা করি সকলে ভালো আছেন?? সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এতদিন আমার পাশে থাকার জন্যে। মানছি আমি আপনাদের মন মতো গল্প উপহার দিতে পারিনি। তবুও আপনারা আমার পাশে থেকেছেন। হ্যাঁ এই গল্পে আমি কিছু রহস্য উদঘাটন না করেই সমাপ্তি টেনেছি। পরে যখন অভিমিষ্টিকে নিয়ে একটা প্রেমকথন লিখবো তখন এই রহস্য উদঘাটন করে দিবো। আশা করি তখন ও আপনারা আমার পাশেই থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে। ]





Post a Comment

Previous Post Next Post